সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বন্দি ‘লুটেরা’ পুলিশ

সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বন্দি ‘লুটেরা’ পুলিশ

মামলার ভয় দেখিয়ে বরিশালগামী মানামী লঞ্চ থেকে নামিয়ে আনা হয় মো. খবির উদ্দিন গাজী নামের এক যাত্রীকে। তাকে মারধর করে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তার সঙ্গে রক্ষিত নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং তার এটিএম কার্ডের মাধ্যমে দুই দফায় আরো ২৫ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর একটি অন্ধকার গলিতে তাকে ছেড়ে দিয়ে কেটে পড়ে লুটেরার দল। আর সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন লালবাগ থানার এএসআই সাজ্জাদ হোসেন মামুন এবং তার অনুগত পাঁচ সোর্স। এমন অভিযোগ করেছেন খবির উদ্দিন গাজী।

খবির উদ্দিন তার অভিযোগে লালবাগ থানার এএসআই সাজ্জাদ হোসেন মামুন ছাড়াও তার আরও তিন সোর্স হিসেবে মো. মাইনুল ইসলাম বাবু, মো. রাকিব হোসেন ও আসলামের নাম উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, আর দুই সোর্সকে তিনি চেনেননি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বরিশালগামী মানামী লঞ্চে এ কা-ের সূত্রপাত বলে জানান খবির। তাকে ঘটনার দিন রাতে মানামী লঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়েছে দুটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় (সিসি ক্যামেরা)। এ বিষয়ে গত বুধবার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা

করেছেন (নম্বর-২৯) ভুক্তভোগী খবির উদ্দিন। তবে সেই লুটের পর ১৪ দিনেও কাউকে আটক না করায় ক্ষুব্ধ খবির উদ্দিন গতকাল রবিবার লিখিত অভিযোগ করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের ‘আইজিপি’স কমপ্লেইন সেল’সহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে।

গতকাল সন্ধ্যায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মো. শাহ জামাল আমাদের সময়কে বলেন, এ ঘটনায় এজাহারনামীয় দুই আসামি আসলাম ও মাইনুলকে রবিবার (গতকাল) সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এএসআই সাজ্জাদের প্রসঙ্গ টানা হলে ওসি বলেন, তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি এএসআই সাজ্জাদ হোসেন মামুন ও তার ৫ সহযোগী খবির উদ্দিন গাজীকে ব্ল্যাকমেইল ও জিম্মি করে ডাকাতি করেন দাবি করে তিনি ‘আইজিপি’স কমপ্লেইন সেল’-এ দাখিল করা অভিযোগে খবির উদ্দিন উল্লেখ করেন বাবু ও রাকিব আমার বাকেরগঞ্জ থানার পূর্বপরিচিত, ঘটনার ৪/৫ দিন আগে রাকিব আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে আপনি বাড়ি যাবেন কবে? আমি তাকে ৯ তারিখের কথা জানাই। যথাদিনে সদরঘাটে এলে বাবুর সঙ্গে আমার দেখা হয়। বাবু ও আমি দুজন মানামী লঞ্চের ২৫৬ নং কেবিন ভাড়া নিই। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমি যখন লঞ্চের করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন এএসআই সাজ্জাদ হোসেন মামুন ও ক্যাপ পরিহিত আসলাম আমার সামনে আসেন। এএসআইয়ের পোশাকে নামযুক্ত কোনো ব্যাজ ছিল না।

সাজ্জাদ আমাকে বলেন, আপনার নাম খবির উদ্দিন গাজী? মাথা নাড়তেই বলেন, আপনার নামে মামলা আছে, স্যার নিচে অপেক্ষা করছেন। এই বলে দুজন আমাকে লঞ্চ থেকে নামিয়ে রাস্তায় অপেক্ষমাণ দুটি মোটরসাইকেলের একটিতে তুলে দেন। গাড়ি দুটো বুড়িগঙ্গার পশ্চিম পাড় দিয়ে এগোতে থাকে। অন্য মোটরসাইকেলটি ছিল আমাদের পেছনে। আমি ভয়ে চেঁচামেচি করলে তারা আমাকে মারধর করতে শুরু করেন। এএসআই সাজ্জাদ আমার মুখে ঘুষি মারেন। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে গিয়ে মাদক দিয়ে চালান করাসহ জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তারা আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এর আগেই আমার প্যান্টের পকেটে থাকা ৫০ হাজার টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। পরে আসলাম আমার এটিএম কার্ড থেকে নাজিমউদ্দিন রোডের একটি ব্র্যাাক ব্যাংকের বুথে ঢুকে প্রথমে ৫ হাজার পরে ২০ হাজার টাকা তুলে নেন। এর পর তারা একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে গেলে আমি ভয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করি। এ সময় তারা আমাকে ফেলে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান।

অভিযোগে তিনি আরো উল্লেখ করেন, আমি ওই রাতে কোতোয়ালি থানায় যাই। পরে থানার ডিউটিরত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানতে পারি ঘটনা যেখানে ঘটেছে, সেটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাভুক্ত এলাকা। সে রাতেই আমি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় গিয়ে হাজির হই এবং একটি অভিযোগ দিই। পরে অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে মানামী লঞ্চ থেকে ভিডিও অনুসন্ধান করে এএসআই সাজ্জাদকে শনাক্ত করি। লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারকেও এ ঘটনার বিস্তারিত জানাই। তিনি থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) মামলা নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাপুলিশ ১১ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপরাধীদের নাম ঠিকানা যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলে কালক্ষেপণ করেন। পরে এএসআই সাজ্জাদ হোসেন ও আসলামের নাম গোপন করে আমার অজ্ঞাতসারে পূর্বের অভিযোগের ওপর মামলা দায়ের করেন। আসামিদের লোকজন আমাকে ফোন করে এএসআই সাজ্জাদ মামুনের সঙ্গে আপস করতে বলেন। অপরাধী যে কোনো সময় আমাকে অপহরণ, গুম, এমনকি খুন পর্যন্ত করতে পারে কিংবা মিথ্যা মামলায় হয়রানি করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছি। তাই আসামিদের গ্রেপ্তারপূর্বক ন্যায়বিচার করা এবং আমি ও আমার পরিবারের সবার নিরাপত্তার জন্য আপনার আইনি সুদৃষ্টি কামনা করছি।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য এএসআই সাজ্জাদ হোসেন মামুনের সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সেদিন সদরঘাটের সেই লঞ্চে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, পরিচিত একজনের উপকার করতে সেদিন লঞ্চে গিয়ে খবির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম সত্যি। কিন্তু সেটি ছিল আমার সেই পরিচিতজনের সঙ্গে খবির উদ্দিনের আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যা মেটানোর জন্য। মামলার ভয় দেখিয়ে এবং মারধর করে মোটা অংকের টাকা আদায়ের যে অভিযোগ খবির উদ্দিন করেছেন, তা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন, পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, খবির উদ্দিন নিজেই একটা প্রতারক। লঞ্চ থেকে খবির উদ্দিনকে তিনি নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কিনা, এ প্রশ্নে এএসআই সাজ্জাদ বলেন, হ্যাঁ, তবে জোর করে নামাইনি। বুথ থেকে খবির উদ্দিন টাকা তুলে দেবেন বলে নিজেই নেমে এসেছিলেন।