বাবার প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হুইপপুত্র শারুন

‘রাস্তাঘাটে যখন প্যান্ট শার্ট খুইলা দিমু তখন বুঝবেন’

‘রাস্তাঘাটে যখন প্যান্ট শার্ট খুইলা দিমু তখন বুঝবেন’

নিজের সামনে দামি মদের বোতল ছড়িয়ে রেখে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়েছিলেন তিনি। একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে গুলিবর্ষণ করার ভিডিওতেও দেখা গেছে তাকে। এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। যদিও এটিকে তিনি রাশিয়ায় একটি শুটিং রেঞ্জে একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে শুটিং করার দৃশ্য বলে দাবি করেছিলেন সাংবাদিকদের কাছে।

তিনি হুইপপুত্র শারুন। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন। বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই ছেলে নিজের অনুসারীদের নিয়ে গঠন করেছেন সমর্থক গোষ্ঠী। নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অল্প বয়সেই তিনি এসেছেন গণমাধ্যমে আলোচনায়। তার নামে আছে ‘শারুন চৌধুরী সমর্থক গোষ্ঠী’। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের পাত্তাই দেন না তিনি।

করোনা ভাইরাসের প্রকোপের আগে দেশজুড়ে জুয়া, ক্যাসিনো বন্ধে শুরু হওয়া অভিযান সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনার জন্ম দেন শারুনের বাবা শামসুল হক চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে ১৮০ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ তুলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এ কারণে তাকে অদৃশ্য শক্তির চাপে বরখাস্ত করা হয়। বাবার পক্ষ নিয়ে এ খবরও দাম্ভিকতার সঙ্গে প্রচার করতে দেখা গেছে শারুনকে। হুইপবিরোধী জনমত ঠেকাতে ওইসময় চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে পটিয়ার কতিপয় নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউন দেন শামসুল ও শারুন।

জুয়াকে সমর্থন দিয়ে র‌্যাবের অভিযানেরও সমালোচনা করেন হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘৩-৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাব ঘিরে রেখে অভিযান পরিচালনা করা হলো। র‌্যাবের অভিযানে ক্লাবের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। কোনো ক্লাবে যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জুয়া বা ক্যাসিনো ব্যবসা চলে তা নিশ্চিত হয়ে এবং খোঁজখবর নিয়েই অভিযান চালানো উচিত’।

তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে আবাহনীসহ বেশ কিছু ক্লাব আছে যেগুলো প্রিমিয়ার লিগে খেলে। এগুলো প্লেয়িং ক্লাব। নিজেদের অবসর সময় কাটাতে ক্লাবের কার্ডধারী মেম্বাররা চাঁদা দিয়ে নিজেরাই তাস খেলে। সেই টাকায় ক্লাবের পরিচালনা খরচ বহন করা হয়। এভাবে অভিযান চালানো হলে ক্লাব বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলেপেলেরা ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হবে। এটা তো কাম্য নয়। তাছাড়া সরকার ক্লাবগুলোকে কোনো টাকা দেয় না’।

এর প্রতিবাদে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর হুইপ শামসুল হকের কুশপুত্তলিকায় ঘৃণা প্রদর্শন এবং তা ঢাকঢোল পিটিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে প্রতিবাদ জানায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করে সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথভঙ্গের অপরাধে শামসুল হক চৌধুরীকে অপসারণেরও দাবি জানানো হয়।

জুয়ার পক্ষে সাফাই গাওয়ার বিরোধীতা করে হুইপ শামসুল হক চৌধুরী আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে দিনে ৬ লাখ টাকা আয় করেন বলে ক্লাবের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান এবং নগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী দাবি করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন হুইপের ছেলে শারুন। তিনি দিদারুল আলম চৌধুরীকে টেলিফোনে প্রাণনাশের হুমকিসহ অকথ্য ভাষায় হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন। পরবর্তীতে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন দিদারুল আলম চৌধুরী।

২০০৭ সালে দিদারুল আলম চৌধুরীকে চট্টগ্রাম আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রাখা হয়। সে হিসেবে প্রিমিয়ার ব্যাংক জিইসি মোড় শাখায় ‘চট্টগ্রাম আবাহনী ফুটবল কমিটি’ নামে একটি যৌথ হিসাব খোলা হয়। হিসাবের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সব ধরনের লেনদেনে ক্লাবের মহাসচিব শামসুল হক চৌধুরী, ম্যানেজার সাইফুদ্দিনের পাশাপাশি দিদারুল আলমের স্বাক্ষর নেওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তাকে অন্ধকারে রেখে ওই হিসাব থেকে টাকা-পয়সা লেনদেন করা হচ্ছিল।

দিদারুল আলম চৌধুরী অ্যাকাউন্ট বন্ধের আবেদন করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সব ধরনের লেনদেন স্থগিত রাখে। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে শামসুল হকের ছেলে নাজমুল করিম শারুন গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায দিদারুল আলমকে মোবাইলে বন্ধ হওয়া ব্যাংক হিসাব খুলে দিতে চাপ দেন। তিনি অস্বীকৃতি জানানোয় একপর্যায়ে তাকে শারুন বলেন, ‘আমরা যদি ক্ষমতা দেখাই আপনি এক শতাংশও টিকতে পারবেন? রাস্তাঘাটে যখন প্যান্ট শার্ট খুইলা দিমু তখন বুঝবেন। বেয়াদবি তো এখনো দেখেন নাই। সম্মান করে কথা বলছি গায়ে লাগতেছে না? গালবাজি যেডে এডে গরিবি রাস্তাঘাটত চোয়ারাই গালর দাঁত বেয়াগুন ফেলাই দিইয়ুম। বেয়াদব হডিয়ার! এই মিয়া তোরে রাস্তাত ধরি পিডিব মাইনস্যে। বেয়াদব! (গালবাজি যেখানে সেখানে করবি রাস্তাঘাটে চড় মেরে মুখের দাঁত সবগুলো ফেলে দেব। বেয়াদব কোথাকার! এই মিয়া তোকে রাস্তায় ধরে পেটাবে মানুষ। বেয়াদব!)

দিদারুল আলম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটাই তো তাদের বেসিক। কাণ্ডজ্ঞান থাকলে এধরনের আচরণ হুইপের ছেলে করতো না। এই দুর্যোগের সময় সবাইকে যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে, সে সময় (২ এপ্রিল) পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঘটা করে হুইপের ছোট ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাবের জন্মদিন উদ্যাপিত হয়েছে। ইউএনও ফারজানা জাহান উপমার কার্যালয়ে এ আয়োজন করা হলেও তিনি মূলত অসহায়। প্রভাবশালী ওই পরিবারের ইচ্ছা পূরণে তিনি বাধ্য হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে’।

দিদারুল আলম চৌধুরী আরও বলেন, ‘হুইপপুত্র শারুন বাবার প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়েছে। তাদের বেসিক তো খুবই হালকা। বার বার দল পাল্টে এমপি হওয়ার পর তা ওভারলোডেড হয়েছে। আল্লাহ সবকিছু দেখছেন’।