সমালোচনা বন্ধ করতেই কি ১১ কার্টুনিস্ট, লেখক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা?

সমালোচনা বন্ধ করতেই কি ১১ কার্টুনিস্ট, লেখক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা?

বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়, তখন থেকেই গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করেছে র‍্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয়েছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ।

তাদের সাথে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-এর পরিচালক ও ব্যবসায়ী মিনহাজ মান্নান ও প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশী সাংবাদিক তাসনিম খলিল এবং সাহেদ আলম।

র‍্যাবের পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবার দুইদিন পরে পরে লেখক দিদারুল ভূঁইয়াকে আজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে 'গুজব ছড়ানোর' অভিযোগে এদের সবার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

গ্রেফতারকৃত মধ্যে অন্যতম দিদারুল ভূঁইয়ার স্ত্রী দিলশাদ আরা বিবিসি বাংলাকে বলেন, তার স্বামী কোন অন্যায় করেনি।

"দেশে অনিয়ম হলে সেটার বিরুদ্ধে লেখার অধিকার সবার রয়েছে। সেও লিখেছে। এটা কোন অপরাধ না। কোনটা রটনা আর কোনটা ঘটনা সেটা সবাই জানে।"

এসব গ্রেফতার এবং মামলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বেশ সমালোচনা মুখর হয়েছেন।

'সরকারের সহিষ্ণুতার অভাব'

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের যে অব্যবস্থাপনা রয়েছে সেগুলো নিয়ে কেউ যাতে কথা বলতে না পারে সেজন্য সবার মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চায় সরকার।

এজন্যই ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন মনে করেন সরকারের সহিষ্ণুতার অভাব থেকেই এ ধরণের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

"এটা কখন হয়? সহিষ্ণুতার এমন অভাব হয়েছে যে তারা (সরকার) সমালোচনা নিতে পারছে পারছে না। যখনই কেউ ভিন্নমত পোষণ করে তখনই মামলা দেয়া হয়, তুলে নেয়া হয়," বলছিলেন কাবেরী গায়েন।

এসব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানা অনিয়ম এবং বিভিন্ন জায়গায় শাসক দলের সাথে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ত্রাণ চুরির অভিযোগ নিয়ে ফেসবুকে অনেকেই সোচ্চার হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, মহামারির এ সময়টিতে সরকারি অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো মূলধারার গণমাধ্যমে তেমন একটা উঠে আসেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

"সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমালোচনার জায়গা তারা বন্ধ করতে চায়," বলছিলেন কাবেরী গায়েন।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা এসব গ্রেফতার এবং মামলা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন।

" মানুষ তার দেশের ভালোর জন্য কথা বলবে না? তাহলে কে বলবে? দেশটা কাদের?" প্রশ্ন তোলেন শিপা হাফিজা।

তথ্য না দিতে নানা বিধি-নিষেধ?

করোনাভাইরাসের বিস্তার যখন দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে সে সময় হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসকদের পিপিই সংকট, টেস্টের অপ্রতুলতা - এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে তখন ডাক্তার এবং নার্সরা তাদের আক্ষেপ ও হতাশার কথা তুলে ধরেন। অনেক ডাক্তার এবং নার্স পিপিই'র অপ্রতুলতার বিষয়টি ফেসবুকেও তুলে ধরেছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে একের পর এক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।

যেসব ডাক্তার এবং নার্স ফেসবুকে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এছাড়া ডাক্তার এবং নার্সরা যাতে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে না পারেন সেজন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাস ভাইরাস সংক্রান্ত প্রতিদিনের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করে শুধু বুলেটিন প্রকাশ করা হচ্ছে যেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা নিয়ে সরকার অস্বস্তিতে থাকে।

স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা এবং করোনা সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে প্রস্তুতির যে ঘাটতি রয়েছে সেটিকে ঢাকতে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

কাবেরী গায়েন বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে যখন সংকট দেখা দেবার আগে সরকার বলেছিলেন তাদের সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু সংকট শুরুর পর উল্টো চিত্র দেখা গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সরকার কী বলছে?

বিবিসি বাংলার তরফ থেকে তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য চাওয়া হয়েছিলো, বক্তব্য চাওয়ার বিষয়টি তাকে অবহিতও করা হয়েছিল বলে জানান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর আকরাম উদ্দিন আহম্মদ ।

এর কিছুক্ষণ পর জনসংযোগ কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামে জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের সাথে সমন্বয় সভায় সভাপতিত্ব করছেন।, যা সাধারণত দেড়-দু'ঘণ্টা স্থায়ী হয়। বক্তব্য দেবার জন্য তথ্যমন্ত্রীকে পাওয়া যাবেনা বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন মি. আহমদ।

বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং যাদের আটক করা হয়েছে তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য তার কাছে নেই।

তবে হতাশা প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি নিজেও ফেসবুকে অবমাননার শিকার হয়েছেন।

তার মায়ের জানাজা নিয়ে ফেসবুকে কেউ-কেউ বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে বলে আইনমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, "ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এক হুজুর মারা যাবার পর তার জানাজায় বেশ লোক সমাগম হয়। আমার মা তার পরদিন মারা যায়। সামাজিক দূরত্ব মেনে খুবই ছোট পরিসরে স্থানীয় একটি মসজিদে পারিবারিকভাবে আমার মায়ের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।"

তিনি বলেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী এবং পাবনার সাবেক সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফের জানাজার ছবিকে আইনমন্ত্রীর মায়ের জানাজার ছবি বলে কেউ-কেউ ফেসবুকে প্রচার করেছে।

"এ ভুয়া ছবি প্রচার করে কেউ-কেউ বলেছে আমার মায়ের জানাজায় লোক সমাগম হলে দোষ হয়না আর হুজুরের জানাজায় লোক সমাগম হলে দোষ হয়," বলছিলেন আইনমন্ত্রী।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, "এই ঘটনার পর কেউ যদি তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করে, তাহলে কি অন্যায় হবে?"

আইনমন্ত্রী বলেন, কাউকে হয়রানি করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়নি। ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কেউ যাতে হয়রানির এবং মিথ্যা তথ্যের শিকার না হয় সেজন্য এই আইন করা হয়েছে।