ঈদ আনন্দ নেই সাতক্ষীরা উপকূলবাসীর

ঈদ আনন্দ নেই সাতক্ষীরা উপকূলবাসীর

ঈদ আনন্দ নেই সাতক্ষীরা উপকূলের লাখো পরিবারে। করোনাকালে এবারের ঈদ ঘরে বসে উদযাপনের সুযোগটুকুও পাবে না উপকূলের মানুষ। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ তাদের সেই সুযোগটুকু থেকেও বঞ্চিত করেছে। উপকূলবাসীর এবারের ঈদ কাটবে খেয়ে না খেয়ে, নৌকায় ভেসে অথবা সাইক্লোন শেল্টারে।

গত ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা উপকূলীয় এলাকা। এতে উপকূলের নদনদীর অন্তত ২০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা ও আশাশুনি সদর এবং কালিগঞ্জ উপজেলার ৫০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ এখনো সংস্কার করা সম্ভব না হওয়ায় প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের সময় নদীর লোনা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। আগে থেকেই সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়ায় প্রাণে বাঁচলেও ভেসে গেছে উপকূলীয় জনপদের ঘরবাড়ি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ। বাঁচার তাগিদে এখন পানিতে ডুবে থাকা নিজ ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন উপকূলের মানুষ। দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। কেউ কেউ কোনোমতে নৌকায় জীবনযাপন করছেন। রাত পোহালেই যে ঈদ, সে কথা ভুলে মনে উঠছে না তাদের।

এমনিতে করোনার কারণে দীর্ঘদিন কর্মহীন হয়ে ঘরবন্দি থেকে আয় উপার্জন ছিল না বললেই চলে। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় আম্পানে থাকার শেষ আশ্রয়টুকুও কেড়ে নেওয়ায় ঈদ আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে উপকূলবাসীর।

পানিতে তলিয়ে থাকা ঘরবাড়ি উদ্ধারসহ দিনে অন্তত একবার খাবারের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে থাকা পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায়নি ঈদ আনন্দ।

সাইক্লোন শেল্টার, নৌকা অথবা খোলা আকাশের নিচে রাত-দিন পার করে দেওয়া পরিবারগুলো দুঃস্বপ্নের মধ্যে বসবাস’ করছে উল্লেখ করে জানায়, বেঁচে থাকার জন্য যারা লড়ছে, ঈদ উৎসব তাদের জন্য নয়।

ভাঙনমুখে থাকা শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালীর শামিমা বলেন, ‘তিনবেলা খাবার জুটতেছে না, তাই ঈদ নে কোন ভাবনা নি। কোন জাগা থেকে কিছু পালি ছাবাল-মেয়ে দুটোর মুখি দে ঈদ এর দিনডা কাটিয়ে দেবানে।’

বুড়িগোয়ালীনি গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন, ভাটায় ফিরলেও জোয়ারে বাড়ি ছাড়তি হচ্ছে, মাছের ঘের আর কাঁকড়ার প্রজেক্ট পানিতে তলিয়ে গেছে। এমন দুরাবস্থার ভেতর নামাজ আদায়ের মধ্যে আমাগো ঈদও এবার সীমাবদ্ধ। আর সেমাই খাওয়ার চেয়ে ভাঙন কবলিত বাঁধে কাজ করা জরুরি হয়ে গেছে। তাই ঈদের নামাজ শেষে অন্যদের সঙ্গে বাঁধের কাজে যাবেন বলেও জানান তিনি।

শুধু আব্দুল জলিল, আর শামিমা নয় বরং আম্পানের তাণ্ডবের শিকার সর্বস্ব হারানো প্রতিটি মানুষের অভিযোগ তাদের ঈদকে ছিনিয়ে নিয়েছে আম্পান। করোনার কারণে আগে থেকে হুমকির মধ্যে থাকা ঈদ উৎসব আম্পানের ধাক্কায় একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে বলেও দাবি তাদের।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, ঈদ নিয়ে তাদের মধ্যে আর কোনো উন্মাদনা অবশিষ্ট নেই। করোনার শুরু থেকে আয় রোজগারহীন থাকায় চরম অর্থকষ্ট চলছিল। সর্বশেষ আম্পানের তাণ্ডব দু’মুঠো খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ দিচ্ছে।

বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের পানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, উপকূলে খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করেছে। একদিকে করোনা, অন্যদিকে আম্পানের তাণ্ডবে সবাই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ঝড়ের পর চার-পাঁচদিন চলে গেলেও এখনো বাঁধ সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। মানুষ নিজ ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় ঈদের আনন্দ কি কাউকে স্পর্শ করতে পারে?

আইলা, সিডর, ফণী ও বুলবুলের ধারাবাহিকতায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপকূলের মানুষ। উপকূলবাসীর এই কান্না যেন দেখার কেউ নেই।

উপকূলের মানুষের দুরবস্থা নিয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ ন ম আবুজর গিফারী বলেন, ঈদ উপলক্ষে পৃথক কোনো বরাদ্দ না থাকায় করোনা ও আম্পানের জন্য পাওয়া বরাদ্দগুলো জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি বাধ সংস্কার করা। দু’একদিনের মধ্যে বাধের কাজ শুরু হবে।

সাতক্ষীলা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো উপকূলের মানুষ ঘরে ফিরতে পারেনি। আশাশুনি উপজেলার এক হাজার পরিবারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে-পোলাও চাল, গরুর মাংস ও সেমাই বিতরণ করা হয়েছে। অন্য উপজেলায়ও করোনা ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রাপ্ত বরাদ্দ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

গত বুধবার (২০ মে) সন্ধ্যার পর ১৪৮ কিলোমিটার বেগে সাতক্ষীরায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানে দুইজন নিহত ও ১৬ জন আহত হন। ঝড়ে ২২ হাজার ৫১৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৬০ হাজার ৯১৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলের নদ-নদীর অন্তত ২০টি পয়েন্টে ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও এলজিইডির ৮১ কিলোমিটার রাস্তা। একই সঙ্গে সাতক্ষীরার ৬৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা ৪০ হাজার টাকার আমসহ ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার কৃষি সম্পদ, ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৩০ টাকার গবাদি পশু এবং ৭৭ লাখ টাকা ৬৭ হাজার ৮৬ টাকার হাঁস-মুরগির খামারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে সাড়ে ১২ হাজার মৎস্য (চিংড়িসহ) ঘের।

এমজে/