করোনার মতো মহামারি আগামীতে আরো হবে

করোনার মতো মহামারি আগামীতে আরো হবে

মানুষ যে সভ্যতা গড়ে তুলেছে তাতে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণ এবং তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার ‌‘নিখুঁত ব্যবস্থা’ করে রাখা আছে। প্রাকৃতিক জগতে মানুষের অনুপ্রবেশ সেই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা, যারা কোথায় এবং কীভাবে নতুন রোগের বিস্তার ঘটে-তা নিয়ে গবেষণা করেন।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে তারা একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যাতে এসব রোগ বিস্তারে প্রক্রিয়ায় কী কী সাদৃশ্য দেখা যায়-তা চিহ্নিত করা সম্ভব, যাকে বলে প্যাটার্ন রিকগনিশন। এ পদ্ধতির ফলে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব, কোন কোন বন্যপ্রাণী মানুষের জন্য সবচেযে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে এটি ভবিষ্যতের কোনো রোগ বিস্তারের জন্য প্রস্তুত থাকার যে বৈশ্বিক প্রয়াস, তার অংশ।

‘আমরা পাঁচটি বুলেট থেকে বেঁচে গেছি’
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথিউ বেলিস বলেন, ‘গত ২০ বছরে আমরা ছয়টি বড় বড় হুমকির সম্মুখীন হয়েছি-সার্স, মার্স, ইবোলা, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সোয়াইন ফ্লু। আমরা পাঁচটি বুলেট এড়াতে পেরেছি। কিন্তু ছয় নম্বরটার হাত থেকে বাঁচতে পারিনি।’

তিনি বলেন, ‘এটাই যে আমাদের সম্মুখীন হওয়া শেষ মহামারি, তা মোটেও নয়। আমাদের বন্যপ্রাণী থেকে মানবদেহে আসা রোগগুলোর দিকে আরো গভীরভাবে নজর দিতে হবে।’

এ পরীক্ষারই অংশ হিসেবে তিনি এবং তার সহযোগীরা এমন একটি প্যাটার্ন-রিকগনিশন পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যার সাহায্যে বন্যপ্রাণী থেকে আসা যত রোগের কথা জানা আছে, তার সবগুলোর উপাত্ত অনুসন্ধান করে দেখা যাবে।

এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা হাজার হাজার ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট বা পরজীবী এবং ভাইরাস সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। অধ্যাপক বেলিসের পদ্ধতি দিয়ে এই অণুজীবগুলো যেসব প্রজাতির প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে-তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সূত্রগুলো চিহ্নিত করা যাবে।

এই সূত্রগুলো দিয়ে আবার এটাও বোঝা যাবে যে কোন কোন অণুজীব মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদি এভাবে রোগ-সৃষ্টিকারী অণুজীব চিহ্নিত হয়-তাহলে বিজ্ঞানীরা কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব হবার আগেই তা ঠেকানোর উপায় উদ্ভাবনের গবেষণা চালাতে পারবেন।

অধ্যাপক বেলিস বলছেন, ‘ঠিক কোন রোগ মহামারির চেহারা নিতে পারে তার গবেষণা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। কিন্তু আমরা এই প্রথম পদক্ষেপটির ব্যাপারে অগ্রগতি ঘটাতে পেরেছি।’

লকডাউনের শিক্ষা
বিজ্ঞানীরা একমত যে বন ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণীর আবাসসভূমিতে মানুষের ঢুকে পড়ার ফলে এখন ঘন ঘন এবং সহজেই প্রাণী থেকে মানুষে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক কেট জোনস বলছেন, মানুষ যেভাবে ইকোসিস্টেমকে বদলে দিয়ে কৃষি বা বৃক্ষরোপণ করছে, তাতে জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে এবং মানুষের নানা সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলেই তারা তথ্যপ্রমাণ পাচ্ছেন।

তিনি বলছেন, অবশ্য সব রোগের ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে তা নয়। কিন্তু কিছু বন্যপ্রাণী যারা মানুষের উৎপাতের ব্যাপারে সবচেয়ে সহিষ্ণু-যেমন কিছু প্রজাতির ইঁদুর-তারা অনেক সময় রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।

ফলে জীববৈচিত্র্য হারানোর ফলে এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে যাতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর ঝুঁকিপূর্ণ সংস্পর্শ বেড়ে যাচ্ছে। তাতে কিছু কিছু ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া বা প্যারাসাইটের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।‍

এ ক্ষেত্রে কিছু রোগ বিস্তারের কথা বলা যায়-যেখানে মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর ‘মধ্যবর্তী পর্ব’ বা ইন্টারফেসের এই যে ঝুঁকি-তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

মানুষ আর বন্যপ্রাণীর মাঝখানের ‘ইন্টারফেস’
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় ও কেনিয়ার আন্তর্জাতিক গবাদিপশু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক এরিক ফেভরে বলেন, যেসব এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাবের উচ্চ ঝুঁকি সেসব জায়গায় গবেষকদের সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে।

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এবং ফার্মের মতো মানুষের কর্মকান্ড-এ দুয়ের মধ্যে যদি কোনো ইন্টারফেসের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সেটা হয়ে উঠতে পারে নতুন রোগ ছড়ানোর হটস্পট। যেমন বনভূমির কাছে একটি পশুপালনের ফার্ম বা যেসব বাজারে প্রাণী বেচাকেনা হয়- এগুলোই হচ্ছে এমন জায়গা, যেখানে মানুষ আর বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের পার্থক্য ঝাপসা হয়ে যায়। এগুলো থেকেই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।

অধ্যাপক ফেভরে বলছেন, ‘আমাদের এরকম ইন্টারফেস কোথাও তৈরি হচ্ছে কিনা তার ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে, এবং অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখলেই তার বাপারে পদক্ষেপ নেবার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

মানব বসতি আছে এমন জায়গায় প্রতি বছর তিন থেকে চার বার নতুন রোগের উদ্ভব হয়। শুধু এশিয়া বা আফ্রিকা নয়, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রেও এটা হচ্ছে।

‘নতুন রোগের ব্যাপারে নজরদারির গুরুত্ব এখন আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পৃথিবীতে মহামারি ছড়ানোর জন্য প্রায় আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছি’ বলছেন অধ্যাপক বেলিস।

অধ্যাপক ফেভরেও এ ব্যাপারে একমত। তার মতে, করোনাভাইরাসের মতো ঘটনা আগামীতে বারবার ঘটতে পারে। তিনি বলছেন, ‘এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে যে কীভাবে মানুয়ের কর্মকাণ্ড প্রাকৃতিক জগতের ওপর প্রভাব ফেলছে।’