করোনার অজুহাতে অফিস ফাঁকির হিড়িক!

করোনার অজুহাতে অফিস ফাঁকির হিড়িক!

পুরাতন অর্থবছর শেষে ও নতুন অর্থবছরের সন্ধিক্ষণে থাকা জুন মাস প্রত্যেক বছরই গুরুত্বপূর্ণ। এসময়ের গুরুত্বকে সামনে রেখেই ঝুঁকির মধ্যেও অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

টানা দীর্ঘ ছুটির পর সরকারি-বেসরকারি অফিস খুললেও কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যারা বিভিন্ন দপ্তরে যাচ্ছেন তাদের কেউ প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না। বিশেষ করে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত ফাইলের বিলম্বিত গতি সব কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

গোলাম মোহতামীম নাঈম ঢাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কিছুদিন আগে মালদ্বীপে আরও ভালো একটি চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সবধরনের সনদপত্র ওই দেশে পাঠাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাবোর্ড ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন প্রয়োজন। সরকারি অফিস খুললেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তিনি কাজগুলো করাতে পারছেন না।

কারণ হিসেবে নাঈম বলেন, যেখানেই যাচ্ছি ঠিকমতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এক টেবিলে কাজ হলে অন্য জায়গায় আটকে থাকছে। এভাবেই সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে।

একাধিক গণমাধ্যম অফিসের হিসাব বিভাগে কথা বলে জানা গেছে, যে অফিসেই তারা তাগিত পাঠাচ্ছেন সেখানেই ফাইল আটকে থাকার তথ্য পাচ্ছেন। কর্মকর্তারা অফিস না করায় ফাইল ছাড়ানো যাচ্ছে না। সচিবালয়সহ সরকারি-বেসরকারি একাধিক অফিস সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার আতঙ্ক তো আছেই। এরমধ্যে অনেকে করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে অফিসে না যাওয়ার ভান ধরছেন। এ কারণে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে কাজে গতি নেই, সমন্বয়হীনতা সর্বত্র।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফাঁকিবাজির নতুন চিত্রও দেখা গেছে। সরকারি অফিস খোলার পর অনেক দপ্তরে রুম খোলা রেখে, লাইট ফ্যান চালিয়ে রাখা হয়, মনে হয় লোকজন আছে। কিন্তু বাস্তবে কেউ থাকেন না।

সরকারি অফিস খুললেও কেন দরকারি কাজে দেরি হচ্ছে তার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, সরকারি একটি ফাইলে সাধারণত একই উইংয়ের একাধিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগে। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফাইলটির কাজ যদি অন্য আরেকটি উইংয়েরও কাজ থাকে তখন দুই উইংয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু এসময়ে একটি উইংয়ের সব কর্মকর্তাই অফিস করছেন না। সেখানে একাধিক উইংয়ের সবাইকে পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে প্রয়োজনীয় কাজের বেশির ভাগই হচ্ছে না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত কাজে সমস্যা হচ্ছে। এ ধরনের ফাইলে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজন ঘোরাঘুরি করেও কোনো সমাধান পাচ্ছেন না। অথচ জুন মাসটি দেশের অর্থবছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুপস্থিতির জন্য শুধু সেবা প্রার্থীরাই অসুবিধায় পড়ছেন না। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন।

তারা বলছেন, অফিসাররা ঠিকমতো অফিস না করায় অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলোও ঠিকমতো হচ্ছে না। গত কয়েকদিনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব জানতে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। নিয়ম অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ের ১৪ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে আসা বিস্তারিত তথ্য একসঙ্গে করে আক্রান্ত এলাকার জন্য পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা। আম্পান আঘাতের ২০ দিন হলেও এখনো পর্যন্ত আম্পানের কারণে ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করতে পারেনি অধিদপ্তর।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মোহসীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লোকবল সংকটের কারণে অনেক কাজ শেষ করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা অফিস করি। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে ভয়, জ্বর, অসুস্থ নানা কথা বলে অফিসে আসছেন না। এ কারণে কিছুটা সময় লাগছে।

করোনাকালেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা ও পদোন্নতির ধারা থামেনি। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা অত্যাধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। করোনার সময়ে সাধারণ মানুষের ঠিক মতো চিকিৎসা পেতে সমস্যা হচ্ছে। হাসপাতালে ঘুরেও সিট পাচ্ছে না। সেখানে সরকারি চাকুরেদের জন্য করোনাকালেও বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত বা মারা গেলে লাখ লাখ টাকার প্রণোদনা পাবেন তার পরিবার। এতো সুযোগ-সুবিধার পরও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস না করার কারণ বুঝতে পারছেন কেউ।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, যত কম কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে অফিস চালানো যায় সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অফিসে যারা উপস্থিত থাকবেন তারা যেন জরুরি প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে পারেন সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া আছে।

তিনি বলেন, আরেকজন অফিসার উপস্থিত নেই বলে কাজ ফেলে রাখা যাবে না। তিনজনের কাজ একজনে করতে হবে।

ফরহাদ হোসেন বলেন, যদি কোনো সরকারি অফিসে জরুরি প্রয়োজনীয় কাজ করাতে সমস্যা হয় তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। সেখানে সমাধান না হলে আমাদের মন্ত্রণালয়ে জানান, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমজে/