'স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে কথা বলা দরকার'

'স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে কথা বলা দরকার'

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম নামের একটি অরাজনৈতিক অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন হায়দার। সেখানে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ইতিবাচক হিসেবে বিশ্লেষণ করা, ঘাটতি চিহ্নিত করা এবং ঘাটতির সমাধান নিয়ে কথা বলা হবে। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কী করে আরেকটু জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় তা নিয়ে কাজ করবে এটি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, 'স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে কথা বলা দরকার।'

বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন হায়দার

এই বিষয়ে জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেন, 'এটা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক অনলাইন প্লাটফর্ম। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ নিয়ে এটি গঠিত হয়েছে। বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জনমুখী, মানবিক এবং জবাবদিহিমূলক করার লক্ষ্যে বর্তমান আইনি কাঠামোর ব্যাপক সংশোধন প্রয়োজন। এর সঙ্গে চিকিৎসক ও নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম। পৃথিবীজুড়ে অনেক দেশে অনেক বাঙালি রয়েছেন, যারা চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তারাও আমাদের এই প্লাটফর্মে রয়েছেন, সবার সদিচ্ছা রয়েছে।'

দেশের বাইরে থেকে হঠাৎ করে এই উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউদ্দিন হায়দার জানান, এর পেছনে রয়েছে তার মায়ের মৃত্যু।

তিনি জানান, ২৩ এপ্রিল দেশের একটি প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালে তার মা মারা যান। তবে মায়ের মৃত্যুটা প্রিভেন্টেবল ছিল বলে তার ধারনা। যদি হেলথ সিস্টেমের জবাবদিহি থাকত, দুর্বলতা না থাকত, মানবিক হতো, মেডিক্যাল ইথিক্স মেনে চলত, তাহলে ওই হাসপাতাল থেকে লাইফ সাপোর্টে থাকা মাকে ভেন্টিলেটর থেকে আলাদা করে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হতো না, আবার নেওয়া হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে সব ব্যবস্থা করে যদি নেওয়া হতো তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত।'

মায়ের মৃত্যুর জন্য সন্তান শোক করবেই, কিন্তু শুধু যদি শোক করি তাহলে মায়ের আত্মার প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, '১৯৯১ সাল থেকে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছি, বিশ্বের ৬৩টি দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছি, তাই অভিজ্ঞতা রয়েছে। চাচ্ছি, সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে, এতে যদি কিছুটা উপকার পায় সাধারণ মানুষ।'

তিনি মনে করেন, দল-মত নির্বিশেষে দেশের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে চান যারা, চিকিৎসক ও চিকিৎসাপেশার বাইরের মানুষ যারা দেশের স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনা নিয়ে বলতে এবং কাজ করতে চান, কিন্তু তারা কোনও প্লাটফর্ম পাচ্ছেন না। এটা এমন একটা ইস্যু, সবার জন্য কমন ইস্যু, তাই মনে করলাম সবার জন্য একটি প্লাটফর্ম দরকার, সবাই যেন সেখানে থাকতে পারেন, কথা বলতে পারেন। সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে এখানে কথা হবে। এসব কারণে বিদেশে থেকেও বাংলাদেশের মানুষের জন্য যদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে কিছুটা হলেও মানুষের কাজে লাগবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই ফেসবুকে এই অনলাইন প্লাটফর্ম করি।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃ ও শিশুর মৃত্যু, টিকাদান কর্মসূচির মতো স্বাস্থ্যসেবাতে অনেক সফলতা বাংলাদেশের রয়েছে, এসব বিষয়ে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বের যে কোনও দেশের চেয়ে কোনও অংশে কম না, বরং দক্ষিণ এশিয়াতে খুবই ভালো। শিক্ষাতে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। কিন্তু দেশ প্রাথমিক হেলথ কেয়ারে যতটা সাকসেসফুল, সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি লেভেলে তারচেয়ে বেশি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যত বেশি ওপরের দিকে গিয়েছে, ততবেশি ফেইল করেছে বলেও জানান বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন হায়দার।

এই কারণে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে যাওয়া দেশের মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, 'কোভিড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে নিজের দেশে চিকিৎসা না নিয়ে কেন মানুষ ঘর-বাড়ি বিক্রি করে দেশের বাইরে যায়, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা কোভিডের কারণে খোলাসা হয়ে গেল।। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা একেবারেই ভঙ্গুর। মূলত এই ব্যবস্থাপনা চিকিৎসক-রোগীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ মনে রাখা দরকার, এই ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকরা মাত্র একটি স্তম্ভ, কিন্তু জড়িত আরও অনেক স্তম্ভ, একটার সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চিকিৎসকরা কিন্তু সেই ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, নিয়ন্ত্রণ করে ওভারঅল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম।'

একইসঙ্গে দেশের পুরো ব্যবস্থা আমলা নির্ভর হয়ে গেছে, অথচ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সর্ম্পকে তাদের সম্যক ধারনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'চিকিৎসকদের অংশগ্রহণ সীমিত, এই ব্যবস্থাতে পরিবর্তন আনতে হবে। কিছু আমলা, কিছু ব্যবসায়ী, কিছু রাজনীতিবিদ এবং তার সঙ্গে কিছু চিকিৎসক যোগ দিয়েছেন; স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যদি এই চিত্র হয় তাহলে সেই সেক্টরে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। তারা চিকিৎসক নিয়োগ, নার্স নিয়োগ, অন্য কর্মী নিয়োগ, কে কোথায় নিয়োগ পাবেন, যন্ত্রপাতি ক্রয়-বিক্রয় এসব কিছুর কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভঙ্গুর হয়ে বসে আছে। যার কারণে নিজের দেশে চিকিৎসা না মানুষ নিয়ে অন্য দেশে যায়।'

কোভিডে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকসহ এতো স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সংক্রামক ব্যধিকে কীভাবে প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সে বিষয়ে চিকিৎসকসহ কাউকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। কীভাবে নিজেদের বাঁচাবে, সেই প্রশিক্ষণও তাদের দেওয়া হয়নি। এসব কিছু নিয়ে মনে হয়েছে, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে দুর্বলতা তা নিয়ে কথা বলা দরকার।'

এই অবস্থার পেছনে চিকিৎসকদের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোর ভূমিকা রয়েছে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, 'মেডিক্যাল সেক্টরের বা পেশাজীবীদের উন্নয়ন নিয়ে কেউ কথা বলেন না, কিন্তু এটা বলা দরকার। এছাড়াও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রোগীদের কাছে জবাবদিহির ভেতরে আনা প্রয়োজন। মেডিক্যাল নেগলিজেন্স বলে একটা টার্ম থাকলেও এর আওতায় কেউ খুব একটা বিচার পায় না। কারণ এখানে কাঠামোগতভাবে আইনি দুবর্লতা রয়েছে, এই আইনের সংশোধন করা দরকার। বর্তমান কাঠামো দিয়ে এটা হবে না। যদিও এগুলো করার কথা ছিল চিকিৎসকদের, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর, সেটা হচ্ছে না। কারণ দলীয় স্বার্থ ছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য কেউ কাজ করছে না। অথচ নিরাপদ এবং মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া কোনও অনুগ্রহ নয়, এটা মৌলিক নাগরিক অধিকার। কিন্তু খুব অবাক ব্যাপার হচ্ছে, পাবলিক পারসেপশন হলো- সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে সেবা পাওয়া যায় না।'

বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের কোনও পার্টনারশিপ নেই, অথচ এটা হওয়া জরুরি ছিল। সরকার যদি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিয়ে পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করাতে পারতো, তাহলে আজ জটিল রোগীরা এমনকি সাধারণ রোগীদেরও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ফেরত দেওয়া হতো না। সরকারের একার পক্ষে এটা সামাল দেওয়া সম্ভব না। এসব কিছু ভাবার সময় এসেছে। আমরা এসব নিয়ে কাজ করতে চাই, সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা না বললে সমাধান হবে না, তাই কথা বলবো।' প্রতি শনিবার নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামে কথা হচ্ছে বলেও জানান জিয়াউদ্দিন হায়দার।