গার্ডিয়ানের রিপোর্ট

রোহিঙ্গা শিবিরে করোনা নিয়ে গুজব, আতঙ্ক, ইন্টারনেট চালুর আহ্বান

রোহিঙ্গা শিবিরে করোনা নিয়ে গুজব, আতঙ্ক, ইন্টারনেট চালুর আহ্বান

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ে নানা রকম গুজব। একবার করোনা শনাক্ত হলেই আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেখানে আক্রান্তকে মেরে ফেলা হচ্ছে- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তাই করোনা পরীক্ষা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে শরণার্থীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে ইন্টারনেটের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে শরণার্থীরা। বৃটেনের প্রভাবশালী অনলাইন দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, করোনা পরীক্ষা নিয়ে নানা রকম গুজব এবং পীড়া দেখা দিয়েছে শিবিরে।

ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ থাকার জন্য তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা করুণ অবস্থায় পৌঁছেছে। সেখানে রয়েছে টয়লেট, সাবান সহ নানা রকম মৌলিক সুবিধায় ঘাটতি। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে অবস্থিত কক্সবাজারে এসব শিবিরে দাতা এজেন্সিগুলো বার বার সতর্ক করছে যে, করোনা ভাইরাস এই শিবিরে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যা মেডিকেল ফ্যাসিলিটিগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ই জুন পর্যন্ত কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছেন ৩৫ জন। মারা গেছেন তিনজন। মোট ৩০ জনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। তবে শনাক্ত হয়নি এমন বহু মানুষ আছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব এসেছে সিজনাল ফ্লুর সঙ্গে। ফলে এর লক্ষণ নিয়ে দেখা দিয়েছে দ্বিধা। রোহিঙ্গা সদস্যরা বলছেন, তারা ক্লিনিক এড়িয়ে চলছেন। কারণ, তাদের মধ্যে ভয় দেখা দিয়েছে যে, একবার করোনা ধরা পড়লেই আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। গত সপ্তাহে কোয়ারেন্টিন থেকে পালিয়েছেন দু’জন। তারা মনে করেছিলেন, তাদেরকে পরিবার থেকে অনেক দূরের কোনো শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বেশির ভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাদের নৃশংসতা থেকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এর আগের নৃশংসতা থেকেও অনেক মানুষ এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ঘটনার পর জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর নৃশংসতাকে গণহত্যার উদ্দেশে হত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়ার তিন বছর পেরিয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু আশ্রয়গ্রহণকারীরা শিক্ষা, জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পায় নি। তাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। বছরের শুরুতে তাদের অনেকে কক্সবাজার থেকে পালিয়ে বিপদসঙ্কুল ১০০০ মাইল দূরে সাগর পাড়ি দিয়ে নৌকায় করে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মাসের পর মাস তাদেরকে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রাখা হয়। কারণ, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে সব দেশই তার সীমান্তে কড়াকড়ি করেছে। তাই কোনো দেশই এসব রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। এ সপ্তাহে কোস্টগার্ড পাহারা দিয়ে শরণার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত ট্রলার থেকে আটক করে ২৭০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে।

আলাদাভাবে আরেকটি বোটে কক্সবাজারের কয়েকশ রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল। তাদেরকে ঘেরাও দিয়ে উদ্ধার করে বাংলাদেশ এবং নিয়ে যাওয়া হয় ভাষাণচরে। এটি হলো পলি জমা পড়ে সৃষ্টি হওয়া একটি প্রত্যন্ত চর। শরণার্থীদের সেখানে নিয়ে রাখা হয় করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি থাকার কারণে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সি বলেছে, মারাত্মক শ্বাসকষ্ট বিষয়ক সংক্রমণের জন্য আইসোলেশনের জন্য ২০০ বেড আছে। চিকিৎসা সেন্টার আছে। আরো কয়েকশ স্থাপন করা হচ্ছে। তবু, একই পরিণতির ভয়ে শঙ্কিত কিছু শরণার্থী।

মোহাম্মদ সাইফুল (২৫) একজন শরণার্থী। তিনি স্ত্রী, এক আঙ্কেল ও এক বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন। তিনি বলেছেন, মিথ্যা বা ভুল তথ্য শিবিরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

তার ভাষায়, ‘গুজব আছে যে, কোয়ারেন্টিনে নিয়ে মানুষ মেরে ফেলা হয়। সেখানে ডাক্তাররা এমন কিছু ইঞ্জেকশন করেন, যাতে মৃত্যু ঘটে। তাছাড়া যাদের করোনা ভাইরাস নেই, তাদেরকেও এই ভাইরাস দিয়ে দিচ্ছেন ডাক্তাররা। তারপর তাদেরকে হত্যা করছেন। লোকজন এসবের কোনো ভিত্তি আছে কিনা তা যাচাই না করেই গুজব বিশ্বাস করছে’।

শরণার্থীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনুরোধ করা হচ্ছে। একই সময়ে সেবামূলক কাজ কমিয়ে দেয়া হয়েছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে। তবে অত্যাবশ্যকীয় সেবা যেমন খাদ্য ও স্যানিটেশন সেবা অব্যাহত রয়েছে।

একজন রোহিঙ্গা নেতা বলেছেন, তার এলাকায় টয়লেটগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

কক্সবাজারে ৭ নম্বর ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ জাফ্ফা বলেছেন, সততার সঙ্গে বলছি, আমরা হাত ধোয়া চর্চা করছি না। পরিষ্কার পরিচ্ছনতা রক্ষা করতে পারছি না। কারণ, হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য দায়িত্ব বিশেষ এনজিওর। তারা ক্যাম্পে আসছেন না।

ওদিকে বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে’র প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেছেন, কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ রোহিঙ্গারা। কিন্তু সেখানে ইন্টারনেট সেবাটা চালু করা উচিত, যাতে মানুষজন খবর জানতে পারে। করোনা মহামারি সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পায়।

তুন খিন আরো বলেন, রোহিঙ্গারা জানতে পারছে না বিশ্বে কি ঘটছে। এই রোগে কি পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ নিয়ে কি হচ্ছে পৃথিবীতে তাদের জানা উচিত। জানা উচিত এ জন্য যে, তাতে পুরো সম্প্রদায় যাতে বিপদ সম্পর্কে বুঝতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার বার বার বলেছে, অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি সাপোর্ট দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। তবে নিরাপত্তাঘটিত কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে।

আবু তাহির (৩৭) নামে একজন রোহিঙ্গা বলেছেন, বাজারঘাট, দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু মানুষজন সারাদিন একটি ছোট্ট রুমের ভিতর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিঃসঙ্গভাবে কাটাতে পারে না।

উল্লেখ্য, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে আবু তাহিরের সংসার। তিনি বলেন, আমার যদি কোভিড পজেটিভ আসে তাহলে কি ঘটবে জানি না। কোয়ারেন্টিন জিনিসটা কি নিশ্চিতভাবে আমি তা জানি না। যদি আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার সন্তান ও প্রিয়জনকে আমার পাশে চাইবো।

বলা হচ্ছে, এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাহলে কেন আইসোলেশনে নেয়া হচ্ছে? আমরা অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। অবশেষে বেঁচে আছি। কারণ, সর্বশক্তিমান আমাদের করুণা করেছেন। তিনিই আমাদের দেখাশোনা করবেন।