কেন সরকারি হাসপাতাল বিমুখ হচ্ছে করোনা রোগীরা?

কেন সরকারি হাসপাতাল বিমুখ হচ্ছে করোনা রোগীরা?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর একমাত্র সরকার নির্ধারিত বিশেষায়িত কোভিড হাসপাতালেই আক্রান্তদের ভর্তি করা হতো। কিন্তু এখন ভর্তি হওয়ার সংখ্যা খুবই কম।

প্রথম দিকে আইসিইউ এমনকি ভর্তির জন্য রোগী নিয়ে অনেকে দৌঁড়ঝাপ করতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি বিবেচেনায় স্বাস্থ্য বিভাগ সরকারি কিছু হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে এবং অস্থায়ী হাসপাতাল বানিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্যোগ নেয়।

রোগীর চাপ সামাল দিতে তিন সপ্তাহের মধ্যে বসুন্ধরায় দুই হাজার বেডের বেশি ধারণ-ক্ষমতার একটি অস্থায়ী হাসপাতাল এর মধ্যে অন্যতম।

সবচেয়ে বড় এ ফিল্ড হাসপাতালটি নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল মানুষের। ৭১টি আইসিইউ বেড স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে যা এখনো চালুর অপেক্ষায়।

হাসপাতালের একজন উপপরিচালক ডা. মোঃ হাবিব ইসমাইল ভুইয়া জানান, ২২শে জুলাই সেখানে রোগী ভর্তি ছিলেন মাত্র ১৭ জন।

অথচ সেখানে কর্মরত আছেন ১৮৬ জন চিকিৎসক ও ১০৩ জন নার্স এবং আড়াইশ আয়া, ওয়ার্ড বয় ও ক্লিনার। গত ২৯শে মে থেকে কোভিড রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে বসুন্ধরায়।

‘আমরা ডাক্তার নার্স সবাই প্রস্তুত রোগীর সেবা দিতে। সবাই মোটিভেটেড আছি। ৪শ অক্সিজেন সিলিন্ডার হাসপাতালটিতে মজুদ আছে রোগীদের সেবা দিতে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের এখানে রোগী নেই,’ বলেন ডা. ইসমাইল ভূইয়া।

অন্যদিকে ঢাকার মহাখালীতে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বহুতল একটি মার্কেটকে ১৫শ শয্যার কোভিড হাসপাতাল বানানোর সব প্রস্তুতির শেষে চালু না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি সপ্তাহ থেকে সেখানে বিদেশগামী যাত্রীদের কোভিড পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ সময়মতো সুযোগ সুবিধা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন মানুষ হাসপাতাল বিমুখ হয়েছে।

‘সরকারের যে পরিকল্পনাগুলো নিয়েছিল এত ঢিমেতালে যে এটি রোগের গতির সাথে এই প্রস্তুতির গতিটা কখনোই তালমেলাতে পারে নাই।’

‘মানুষকে শুধু তাদের সামনে মুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল- তিন হাজার শয্যাবিশিষ্ট ওই হাসপাতাল হচ্ছে, নয়তলা এই হাসপাতাল হচ্ছে... এগুলো করারতো কোন দরকার ছিল না।’

মি. লেনিন বলছেন, ‘আমাদের যা ছিল সেটাকেই যদি আমরা সঠিকভাবে সুসজ্জিত করে আর যে অবকাঠামোগুলো অবহেলিত ছিল, কাজে লাগছিল না সেগুলোকে যদি কাজে লাগাতাম তাহলেই কিন্তু আমাদের সমস্যা সমাধান হতো।’

খালি পড়ে আছে হাসপাতালের বেড
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে, সারাদেশে সরকারি কোভিড হাসপাতালে মোট সাধারণ শয্যার সংখ্যা ১৫ হাজার ৪৪৮টি এর মধ্যে ১১ হাজার ৯৮টি খালি।

এছাড়া ৫১৪টি আইসিইউ ইউনিটের মধ্যে ২১৭টি খালি আছে। সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তির এ পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন করে আর কোন কোভিড হাসপাতাল চালু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এমনকি অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক সব কোভিড হাসপাতাল রাখার প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়টিও পর্যালোচনাও শুরু করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র আয়েশা আক্তার বলেন, ‘এখন আমরা নতুন করে আর কোনো হাসপাতাল নেয়ার প্রয়োজন দেখছি না। যেহেতু আমাদের যা আছে এক্সিসটিং তা নিয়েই আমাদের চলছে।’

‘আমরা চাইছি যেগুলো আছে সেগুলোর সুযোগ সুবিধা বাড়াতে। মৃত্যু হারটা যেন কম হয় সেটা নিশ্চিত করতে। সংক্রমণ যদি আরো কমে এবং আক্রান্তের সংখ্যা আরো কমলে আমাদের কোভিড হাসপাতালগুলো ব্যাপারে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে। এ বিষয়ে কমিটি পর্যালোচনার কাজ চলছে।’

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চাপ অব্যাহত
এদিকে বাংলাদেশে এখনো ব্যাপক সামাজিক সংক্রমণ চলছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চাপ অব্যাহত আছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালের এত বেড এবং আইসিইউ খালি থাকার কারণ হিসেবে আক্রান্ত এবং তাদের স্বজনরা জানাচ্ছেন বাধ্য না হলে কেউ এখন হাসপাতালে যাচ্ছেন না। আর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে কাঙ্খিত সেবা পাবেন কিনা সেটি নিয়েও সংশয়ে আছেন সাধারণ মানুষ।

ঢাকা বিভাগের নুসরাত ইয়াসমিন করোনা আক্রান্ত স্বামীকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন ২৮শে জুন। বাড়িতে চিকিৎসা এমনকি অক্সিজেন দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন হাসপাতালে ভর্তি না করার।

কিন্তু শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হন। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় টিভিতে, ফেইসবুকে, বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছি যে সরকারি হাসপাতালে আসলে সেভাবে মানুষ ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে না। ডাক্তার সময়মতো আসছে না।’

‘তাই আমরা ডিসিশন নিলাম যে আমরা প্রাইভেটেই যাব। এছাড়া আমার বড় ভাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তার অভিজ্ঞতা ভাল না। আমার বাড়ির কেয়ারটেকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি তার কাছ থেকেও খবর পাচ্ছি যে সেখানে সেবা ভাল না।’

আস্থাহীনতার কারণেই হাসপাতাল যাচ্ছে না মানুষ?
এসবকিছুর পরেও সরকারি হাসপাতালে বিপুল পরিমাণে শয্যা খালির বিষয়টি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার কারণেই বলে মনে করেন ডা. লেলিন চৌধুরী।

‘কোভিড রোগীর সাথে অন্য যে রোগী আছে সবমিলে এখনতো হাসপাতাল একদম টইটুম্বুর থাকার কথা কিন্তু ফাঁকা থাকছে।। ইতোমধ্যেই সরকারি হাসপাতাগুলোতে গিয়ে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে মানুষজনকে এই পরিমাণ ভোগান্তি পেতে হয়েছে যে তারা এখন আর হাসপাতালমুখী হতেই আর আগ্রহী না। বরঞ্চ প্রচুরসংখ্যক লোক মনে করে হাসপাতালে গেলে কষ্ট বেশি পাব ওর চেয়ে বাসায় থাকি সেটাই ভাল।’

করোনা আক্রান্ত রোগীদের আশি ভাগের বেশি মৃদু উপসর্গ থাকে তাদের এমনিতেই হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু শুরুর দিকে আক্রান্ত সবাই হাসপাতালে ছুটেছে। সেই আতঙ্ক অনেকটা কমেছে।

এছাড়া ভাইরাসে এবং রোগ মোকাবেলা করে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে কীভাবে চলতে হবে সেটাও মানুষ অনেকটা আয়ত্ব করেছে।

সরকারি হাসপাতালে রোগী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আয়েশা আক্তার বলেন, ‘এখন কিন্তু জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল আর এন্টি হিস্টামিন ওষুধ খেলে তিন-চারদিনের মধ্যে ভাল হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে থাকলেও আমরা ফলোয়াপ করছি। সেক্ষেত্রে হাসপাতালে ভিড়টা অনেকটা কম হচ্ছে।’

‘যার জন্য দেখা যাচ্ছে আমাদের এখন কিছুটা হলেও বেডটা ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কিন্তু কোভিড ননকোভিড আলাদা করে ভর্তি নেয়া হচ্ছে।’

২৩শে জুলাই পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট ২ লাখ ১৬ হাজারের বেশি আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৯৪ হাজারের বেশি সক্রিয় রোগী আছে। ওয়ার্ল্ডোমিটার এ তথ্য দিয়ে জানাচ্ছে সক্রিয় রোগীর তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম আর এশিয়ায় দ্বিতীয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা।