স্বাস্থ্যের নয়া ডিজির বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক

স্বাস্থ্যের নয়া ডিজির বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক

‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে হবে না। দুর্নীতির দায় সবার’ বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নব নিযুক্ত ডিজির দেয়া বক্তব্য নিয়ে সর্বত্র বিতর্কের ঝড় উঠেছে।বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাতে যেখানে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, সেই দুর্নীতির দায় সবার উপরে চাপিয়ে প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি কাকে খুশি করতে চাচ্ছেন সেই প্রশ্ন এসেছে।

তারা বলছেন, এই কথার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ডিজি করোনাকালে প্রকাশিত স্বাস্থ্যখাতের মহাদুর্নীতির জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ও কিছু ব্যক্তি বিশেষকে রক্ষা করার অপচেষ্টা করছেন। তার এই বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় স্বাস্থ্যখাতের এই দুর্নীতি লুটপাটের বিচার করার সদিচ্ছা তার নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি দায়িত্ব নিয়ে যখন মানুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনার কথা, তার প্রশাসনকে অতীতের দুর্নীতির জন্য সাবধান করে দেয়ার কথা, সেখানে উল্টো জনগণের উপরেই দুর্নীতির দায় চাপিয়ে বক্তব্য জনমনে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, নয়া ডিজি এই বক্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির চক্রকে আগের কায়দায় চালিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত দিয়েছেন। এমন অবস্থায়, স্বাস্থ্যখাতের দীর্ঘদিনের এই লুটপাট, দুর্নীতির বিচার তিনি আদৌ করবেন কি না সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।

সামাজিক মাধ্যমে ডিজির বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ‘দুর্নীতির দায় সবার বলতে’ তিনি কি বুঝাতে চান সেই প্রশ্ন রেখেছেন অনেকে। অনেকে বলছেন, নতুন ডিজি ইনিয়ে বিনিয়ে মূলত দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার মত করে কথা বলছেন। তিনি আসতে না আসতেই দুর্নীতির দায় অন্যের উপর চাপানোর পায়তারা শুরু করেছেন।

২৫ জুলাই দায়িত্ব বুঝে নেয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

এ সময় তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে হবে না। দুর্নীতির দায়টা সবার। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে সৎ না হলে কোনোভাবেই দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বলব দুর্নীতির দায় আমাদের সবার। আমরা যদি শুধু সরকারের দিকে আঙুল তুলি, সেটা হবে সবচেয়ে বড় বোকামি। আমরা সবাই এই দুর্নীতির অংশ।’

স্বাস্থ্যের নয়া ডিজির ওই বক্তব্যের পরপরই সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্নমহলে এর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ডিজির এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠায় ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)।

ওই বিবৃতিতে চিকিৎসক নেতারা বলেন, ‘এই কথার মাধ্যমে (স্বাস্থ্যের ডিজি) করোনাকালীন সময়ে প্রকাশিত স্বাস্থ্যখাতের মহাদুর্নীতির জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ও কিছু ব্যক্তি বিশেষকে রক্ষা করার অপচেষ্টা করছেন। বিভিন্ন সেক্টরে গত এক যুগে ঘটে যাওয়া সরকারের দুর্নীতির মহাপ্রলয়ের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ হলো স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি। সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ব্যতীত দুর্নীতির এমন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অসম্ভব।’

তারা আরো বলেন, ‘নবনিযুক্ত মহাপরিচালক সরকারকে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত গুটিকয়েক ব্যক্তিকে আড়াল করে এর দায় হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের উপর চাপানোর চেষ্টা করছেন।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়োগ পেয়েই স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি কাকে সন্তুষ্ট করতে কিংবা কার রোষাণল থেকে আগেভাগেই নিজেকে রক্ষা করতে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া স্বাস্থ্যখাতের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নতুন ডিজি একজন ধর্মযাজক বা ধর্মগুরুর মতো কথা বলছেন। তারা মানুষকে সৎ থাকার উপদেশ দেবেন, ন্যায়ের কথা বলবেন, সবার কাছে সততা আশা করবেন অর্থাৎ এক ধরনের ইউটোপিয়ান ইল্যুশন তৈরি করে মানুষকে তার মধ্যে যুক্ত করবেন; সেটাই স্বাভাবিক। এটা কোনোক্রমেই একজন প্রশাসকের কথা হতে পারে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেখানে সকল খাতে একজন অতি দক্ষ এবং শক্ত প্রশাসকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে এই ধরনের ইউটোপিয়ান ইল্যুসিভ কথাবার্তা মানুষকে কোনোভাবেই ভরসা যোগায় না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি রোধ করতে যদি সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে সৎ হতে হয় তাহলে জনগণের করের টাকায় একটা আস্ত প্রশাসন পোষা হচ্ছে কেন? এই অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে সরকার পরিচালনার ব্যয়ই হচ্ছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা আর পেনশন গ্র্যাচুইটি বাবদ ব্যয়ই হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল খরচ করে কেন এমন প্রশাসক পুষতে হবে যিনি দায়িত্ব এড়াতে কথা বলেন ধর্মগুরুর মতো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের আর সব খাতের মতোই একেবারে পচে যাওয়া স্বাস্থ্য খাতে নিযুক্ত নতুন মহাপরিচালকের কাছ থেকে জনগণ দেখতে চেয়েছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে চরম কঠোরতা। তার ঘোষণা করা উচিত ছিল অপরাধী যেই হোক না কেন, যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। অথচ তিনি করছেন জনগণকে সৎ হবার নসিহত।

তিনি দুর্নীতির দায় সরকারকে দিতে রাজি নন। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য যদি সরকার দায়ী না হয়, তাহলে দায়ী কে? স্বাস্থ্য খাতে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে কারা? তার সুবিধাভোগী কারা? এর সঙ্গে যুক্ত লোকজন কারা? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, দুর্নীতির সঙ্গে সরকার যুক্ত নয়, তাহলেও এই দুর্নীতি রোধের দায়িত্ব কার কাঁধে বর্তায়? দুর্নীতির দায় সবার বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? এই দায় কি ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীর? নাকি যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তার? নাকি তার পরিবারের? নাকি যারা এই দুর্নীতির বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসছেন তাদের, অর্থাৎ গণমাধ্যমের?

বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন,স্বাস্থ্যের নয়া ডিজি স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির জন্য যে ‘সবাই’কে দায়ী করেছেন, সেই সবার মধ্যে কি চিকিৎসা না পেয়ে অসহায় ও করুণভাবে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিরা আছেন? আছেন আইসিইউ না পেয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসকেরা? হাসপাতালে ঠাঁই না পাওয়া রোগীকে রাস্তার মধ্যে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচাতে না পেরে যে চিকিৎসক হতাশায় মুষড়ে রাস্তাতেই বসে গেলেন, এই অব্যবস্থাপনার দায়ের ভাগীদার কি তিনিও? তাঁদেরও কি দায়ী করলেন ডিজি ? রিজেন্ট কেলেঙ্কারির খলনায়ক-নায়িকা সাহেদ ও সাবরিনা কিংবা নকল মাস্ক সরবরাহকারী শারমিন জাহানের দায় কোন পদ্ধতিতে সবার মধ্যে, অর্থাৎ সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে সমভাবে বেঁটে দেবেন তিনি? অসহায় মা-বাবা কিংবা কোলের শিশুকে নিয়ে অক্সিজেনের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো মানুষ আর যারা এই অবস্থার মধ্যে ফেলেছে, তারা কি এক? তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?

বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, করোনা আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণই উদোম করে দিয়েছে। দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, সমন্বয়হীনতা, প্রতারণা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জালিয়াতি এই সবই প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে এই সময়। মানুষ মূল্য দিয়েছে জীবন আর জীবিকার বিনিময়ে। ভুয়া রিপোর্টের কারণে রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজিসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরা হলো, আনা হলো আইনের আওতায়। সরানো হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বয়ান মতে উপরের নির্দেশেই তারা এই কাজ করেছে। তারপরও রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত থেকেও রয়ে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আসলেন নতুন মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া সাবেক ডিজির আসনটি এখন তাঁর। যে আসন ব্যবহার করে করোনা মারামারির সময়ে মানুষের জীবন ও রাষ্ট্রের সম্পদ নিয়ে অকল্পনীয় দুর্নীতিগুলো হয়েছে, সেই আসন একজন যোগ্য ও সৎ সরকারি কর্মকর্তাকে দেওয়া হবে, এটাই ছিল মানুষের চাওয়া। সাবেকের অপসারণ এবং নতুনের আগমনের মধ্যে মানুষ ইতিবাচক পরিবর্তনই দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু কাজের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় পাওয়ার আগে তিনি তাঁর মনোভাবের পরিচয় দিলেন কথায়। তাঁর মুখ থেকে জনগণ শুনেছে, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে হবে না। দুর্নীতির দায়টা সবার।’

বিশ্লেষকরা মনে করেন, করোনার এই বীভৎস সময়ে একজন কঠোর, দক্ষ, সৎ প্রশাসকের বড় প্রয়োজন ছিল, যিনি কথা ও কাজে শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করবেন, একজন ধর্মগুরু নয়, যিনি ইতিমধ্যেই নানা অব্যবস্থাপনায় নাকাল হওয়া জাতিকে সৎ হবার নসিহত করবেন।

নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, করোনা মহামারির সময়ে যখন মানুষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাদের দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে ক্রুদ্ধ, তখন এসব গণবিধ্বংসী অপরাধীর দায় লাঘবের চেষ্টা কাটা ঘায়ে লবণ ছিটানোর মতো। স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি দায়িত্ব নেয়ার পর যখন মানুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনার কথা, তার প্রশাসনকে অতীতের দুর্নীতির জন্য সাবধান করে দেয়ার কথা, সেখানে উল্টো জনগণের উপরেই দুর্নীতির দায় চাপিয়ে বক্তব্য জনমনে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, নয়া ডিজি এই বক্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির চক্রকে আগের কায়দায় চালিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত দিয়েছেন। এমন অবস্থায়, স্বাস্থ্যখাতের দীর্ঘদিনের এই লুটপাট, দুর্নীতির বিচার তিনি আদৌ করবেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।