চেয়ার নড়ে না ৩ ওয়াসা এমডির

চেয়ার নড়ে না ৩ ওয়াসা এমডির

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট প্রথমবার সরকার গঠনের পর বছরখানেকের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বসেন তিন প্রভাবশালী প্রকৌশলী। ২০০৯ ও ’১০ সালে সংস্থাগুলোর প্রধান নির্বাহীর চেয়ারে বসে দফায় দফায় তারা বাগিয়ে নিয়েছেন চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সরকারদলীয় সমর্থক অনেক প্রকৌশলীকেও বরখাস্ত করাসহ নিজেদের পছন্দমতো সাজিয়েছেন পুরো সংস্থার প্রশাসন। এভাবে প্রায় এক যুগের দ্বারপ্রান্তে এসেও তিন সংস্থার এমডি পদে আবারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেবাধর্মী এ তিন সংস্থার ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় কেউ এমডির চেয়ারে থাকতে পারেননি। তিন এমডির মধ্যে ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর। আর চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি একেএম ফজলুল্লাহ ২০১০ সালে ও খুলনা ওয়াসার এমডি আবদুল্লাহ ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর নিয়োগ পেয়ে এখনো পর্যন্ত কর্মরত আছেন। সংস্থা তিনটির শীর্ষ এ তিন কর্মকর্তার কেউ কেউ এ পর্যন্ত তিন থেকে পাঁচবার পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আর খুলনা ওয়াসার বর্তমান এমডির মেয়াদ শেষ হবে ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর।

ঢাকা ওয়াসায় তাকসিমের ১১ বছর : ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিম এ খান প্রথম নিয়োগ পান বর্তমান সরকারের সময়ে ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর। সংস্থাটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এ ব্যক্তি প্রায় ১১ বছর এ পদে কর্মরত আছেন। তাকসিমকে প্রথমবার এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, সে শর্তের কোনোটিই তার ছিল না। এরপরও ঢাকা ওয়াসার তৎকালীন বোর্ড নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে তাকসিম এ খানকেই নিয়োগ দেয়। নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর তাকসিমকে এমডি হিসেবে আরেক দফায় এক বছরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সময় ওয়াসার বিধিবদ্ধ আইনকে পাশ কাটিয়েই এক বছরের জন্য তাকসিম এ খানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর আবারও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি এবং পরীক্ষা ছাড়াই তাকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের অক্টোবরে পঞ্চমবারের মতো এমডি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন। আগামী ১৪ অক্টোবর শেষ হবে তার এ মেয়াদ। এবারও তিনি ওয়াসা বোর্ডকে তাকে ষষ্ঠবারের মতো নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য প্রস্তুত করছেন বলে জানা গেছে।

ওয়াসার একাধিক প্রকৌশলী বলেন, তাকসিম এ খানকে প্রথমবার নিয়োগ দেওয়ার সময় তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ওয়াসা বোর্ডকে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছিলেন। এর পরের নিয়োগেও বোর্ড তিন বছরের প্রস্তাব পাঠালে তা কেটে দিয়ে এক বছরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। তৃতীয় মেয়াদে ওয়াসা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শীর্ষ পর্যায়ের আশীর্বাদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন। পর্যায়ক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চমবার তিনি এ পদে থাকতে নিজের ইচ্ছামতো নিয়োগ প্রক্রিয়া সাজান। এ কর্মকর্তার পাঁচটি ধাপের নিয়োগেই লঙ্ঘিত হয়েছে ওয়াসার এমডি নিয়োগসংক্রান্ত সব ধরনের বিধিবিধান। এবারও তিনি ষষ্টবারের মতো নিয়োগ পেতে সব আয়োজন সম্পন্ন করছেন।

১১ বছর খুলনা ওয়াসার এমডি : খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুল্লাহ সংস্থাটির শীর্ষ পদে বসেন ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর। এরপর তিনি তিন বছর করে তিনবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। ১১ বছর এ পদে থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমডি আবদুল্লাহ তার স্ত্রী আনজুমান আরার নামে রাজধানীর শ্যামলী ২ নম্বর রোডের ৯/৪ হোল্ডিং নম্বরের (অমরজ্যোতি) ভবনে একটি ১৫০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। আর ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকায় ১১ নম্বর বাসার দ্বিতীয় তলার (সি/২, ওয়েস্টার্ন টাওয়ার) ফ্ল্যাটটিও তার নিজের। প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের এ ফ্ল্যাটটিতে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন বলে জানা গেছে। এছাড়া শেরপুরের বটতলা এলাকায় রয়েছে তার একটি অটো রাইস মিল। এটিও তিনি স্ত্রী আনজুম আরা ও নিকটাত্মীয়দের নামে করেছেন। সরকারি একটি সংস্থার তদন্তেও এ কর্মকর্তা ও তার পরিবারের নামে প্রায় ৫৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও কয়েকটি ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের তথ্য বেরিয়ে আসে।

খুলনা ওয়াসার কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, সংস্থাটির শীর্ষ পদে থাকা এ কর্মকর্তার নিয়োগের শুরুতেই রয়েছে নানা অভিযোগ। দুই দফায় চুক্তি বাড়িয়ে নিয়ে তৃতীয় দফায় তাকে নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সে সুপারিশ বাতিল হয়। এরপর বোর্ডের ৫৫তম সভায় এমডি নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক একটি মাত্র জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সেদিনের এ জাতীয় পত্রিকাটি খুলনার কোথাও পাওয়া যায়নি এবং ওয়াসার ওয়েবসাইটেও সেই বিজ্ঞপ্তি ছিল না। এছাড়া এ কর্মকর্তা নিজে পদে থাকতে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগের সময় এমডি নিয়োগের বয়সসীমায় নিজের ইচ্ছামতো শর্ত দিয়েছেন। ওয়াসার নিয়োগ বিধিমালায় বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের জন্য দুই বছর পর্যন্ত বয়সসীমা শিথিল করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আবদুল্লাহ নিজের নিয়োগের ক্ষেত্রে বারবার বয়সসীমা শিথিল করেন ইচ্ছামাফিক।

১০ বছর চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি : প্রায় ১০ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি পদে আছেন একেএম ফজলুল্লাহ। তিনিও তিন দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। ছাত্রজীবনে জাসদের সক্রিয় কর্মী থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি সুদৃষ্টিতে আসেন। ১৯৬৮ সালে ওয়াসার চাকরিতে যোগদান করেন। পরে ১৯৯৮ সালে পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান। ওয়াসায় চাকরিকালে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এ প্রকৌশলী শীর্ষ পদে বসে আত্মীয়স্বজনকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া এবং বোর্ডকে উপেক্ষা করে প্রকল্প নিয়েছেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেননি।

এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এমজে/