নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত, দুর্ভোগে লাখো মানুষ

নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত, দুর্ভোগে লাখো মানুষ

একদিকে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানির চাপ, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে ভারি বৃষ্টির সঙ্গে অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়।

এই দুইয়ে দেশের দক্ষিণে উপকূলীয় জেলাগুলোর নদ-নদীর পানি বইছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। এতে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।

দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যার বিপদ কাটেনি। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বইছে বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। ফুঁসে উঠছে মেঘনাও।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল কার্যালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গতকাল দুপুর ১২টায় বরিশালে কীর্তনখোলার পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া হিজলায় ধর্মগঞ্জ নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার, মির্জাগঞ্জে বুড়িশ্বর বা পায়রা নদীর পানি ৬৪ সেন্টিমিটার, আমতলীতে বুড়িশ্বর বা পায়রা নদীর পানি ৩৭ সেন্টিমিটার, পাথরঘাটায় বিষখালী নদীর পানি ৫০ সেন্টিমিটার, বরগুনায় বিষখালী নদীর পানি ৫৭ সেন্টিমিটার, ভোলায় তেঁতুলিয়া নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার, ভোলার দৌলতখানে মেঘনা-সুরমা নদীর পানি ১০৯ সেন্টিমিটার, পিরোজপুরে বলেশ্বর নদের পানি তিন সেন্টিমিটার এবং কচা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল।

কচা ও বলেশ্বর নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো দিয়ে পানি ঢুকে পড়ছে পিরোজপুরের লোকালয়ে। প্লাবিত হয়েছে ভাণ্ডারিয়া, ইন্দুরকানী উপজেলাসহ নদমূলা, চরখালী, দারুলহুদা, মাদার্শী, ইকড়ি, সিংহখালী, আতরখালী, পূর্ব পশারীবুনিয়া, তেলিখালী, হরিণপালা, উত্তর ভিটাবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল। এসব এলাকার উঠতি পাকা ইরি ধান তলিয়ে রয়েছে। এতে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে রয়েছে কলারন খেয়াঘাট এবং টগড়া ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে। নদীতে অস্বাভাবিক স্রোতের কারণে টগড়া-চরখালী ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

ঝালকাঠির অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায়। পানি ঢুকে পড়েছে শহরের অলিগলি ও রাস্তাঘাটে। দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে জেলার নদীতীরের বাসিন্দারা।

বিষখালী নদীর ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে কাঁঠালিয়া ও রাজাপুর উপজেলার নদীতীরের গ্রামগুলোতে। এ ছাড়া নলছিটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে বসতঘর, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের।

দুই দিন ধরে পানিতে ডুবে আছে বরিশাল নগরীর বেশির ভাগ এলাকা। জোয়ারের সময় বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোডও তলিয়ে যাচ্ছে।

নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ১১টি ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাকা আউশ ধান। অনেকে বেড়িবাঁধে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে জোয়ারের সময় বাগেরহাট শহরের বিভিন্ন সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, রামপাল, মোংলা, চিতলমারী, কচুয়াসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের সময় প্লাবিত হচ্ছে। তবে ভাটার সময় অনেক এলাকা থেকে পানি নেমেও যাচ্ছে।

জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জোয়ারের সময় প্লাবিত হচ্ছে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশ। আম্ফানের জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে গত দুই দিন জোয়ারে বেশি পানি দেখা গেছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে।

চিতলমারী উপজেলার হাজার হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এ অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়নকাজ বন্ধ থাকায় খিলিগাতী, রায়গ্রামের নারানখালীসহ গুরুত্বপূর্ণ স্লুুইস গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে পানি দ্রুত চলে যায়। স্থানীয় লোকজন জানায়, প্রায় ৪০ শতাংশ মাছের ঘের ভেসে গেছে এবং প্রায় ৬০ শতাংশ সবজি নষ্ট হয়েছে।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ভেঙে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত তিন দিনের বিরামহীন বর্ষণে আম্ফানের পর সংস্কার করা বেড়িবাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে নদীর পানির তীব্র চাপে সেগুলো একের পর এক ভেঙে পড়ছে বলে এলাকাবাসী জানায়। জোয়ারের সময় ১২ থেকে ১৩ ফুট পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গতকাল ভোরে জোয়ারের তোড়ে রিং বাঁধ ভেঙে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে আশপাশের পুরো অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

প্লাবিত হয়েছে যশোরে কেশবপুরের নিম্নাঞ্চলও। ভবদহ এলাকার বিল খুকশিয়ার অববাহিকায় সুফলাকাটি ইউনিয়নের সানতলা, কালিচরণপুর, আড়ুয়া, গৃধরনগর, কানাইডাঙ্গা, পাঁজিয়া ইউনিয়নের বাগডাঙ্গা, পাথরঘাটা, মনোহরনগর এবং কেশবপুর সদর ইউনিয়নের ব্যাসডাঙ্গা এলাকার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে।

অস্বাভাবিক জোয়ারে ফের খুলনার কয়রার বিস্তৃত এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে বাঁধ ভেঙেছে পাইকগাছায়। স্থানীয় লোকজন জানায়, ফলে বেশির ভাগ রিং বাঁধ উপচে পানি পড়ছে। এর আগে বেদকাশী, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, কাশিরহাট খোলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া পাইকগাছা উপজেলার শিবসা নদীর পানির চাপে হাড়িয়ার বাঁধ গত বুধবার ভেঙে গেছে। স্থানীয় লোকজন গত বৃহস্পতিবার স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করে।

অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে ভেঙে গেছে কক্সবাজারের পেকুয়ায় বেড়িবাঁধ। এতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে জোয়ারের পানি। এতে অন্তত আটটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে প্রায় পাঁচ হাজার একর রোপা আমনক্ষেত।

জোয়ারের পানির চাপে বারবাকিয়া ইউনিয়নের বুধা মাঝির ঘোনা পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে বুধা মাঝির ঘোনা, পূর্ব বুধা মাঝির ঘোনা, পশ্চিম বুধা মাঝির ঘোনা, জালিয়াকাটা ও দক্ষিণ বুধা মাঝির ঘোনার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা নদীর পানি বেড়ে এলাকার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে চার সেন্টিমিটার বেড়ে বিপত্সীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে উপজেলার দৌলতদিয়া, দেবগ্রাম, ছোট ভাকলা ও উজানচর ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এতে শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর আগে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বানভাসিদের অনেকে নিজেদের বসতভিটায় ফিরেছিল। ফের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় তাদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আবারও স্কুল, বেড়িবাঁধ ও মহাসড়কের ঢালে আশ্রয় নিচ্ছে।

একদিকে জোয়ার, অন্যদিকে উজানের বন্যার পানিতে ফুঁসে উঠেছে মেঘনা। এতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে চাঁদপুর সদর, হাইমচর ও মতলব উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে অনেক মাছের খামার ভেসে গেছে।

প্রচণ্ড ঘূর্ণিস্রোতের কারণে চাঁদপুর শহরের তিন নদীর মোহনা এখন ঝুঁকির মুখে। ঝুঁকিতে চলাচল করছে নৌযানগুলো।

এমজে/