ক্ষমা চেয়ে হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর লাশ নিয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা

ক্ষমা চেয়ে হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর লাশ নিয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। তার সামনেই ছেলে রাকিবুল ইসলাম লিটনকে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়। ওই সময় লাঞ্ছনার শিকার হন রাকিবুল ইসলামের সহকর্মী মুস্তাফিজুর রহমানসহ আরও বেশ কয়েকজন স্বজন।

এর আগে বুধবার সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর স্ত্রী পারুল বেগম। নানা হয়রানি শেষে দুপুর নাগাদ মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর মরদেহ নিয়ে যান। ক্ষমা চান তার ছেলেও।

কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাকিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুপুরে রামেক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুক্তার হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন নগরীর রাজপাড়া থানায়। সরকারি কাজে বাধা দেয়ার মামলায় আসামি করা হয় রাকিবুল ইসলামকে। হাসপাতাল থেকেই তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। দুপুরের পর তোলা হয় আদালতে।

বিকালে আদালত তাকে তিনদিনের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন। আগামী রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) তার আদালতে হাজির হওয়ার কথা। মহানগর আদালত পুলিশের পরিদর্শক আবুল হাসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ভুক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামের বাসিন্দা। পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা পরিবার নিয়ে রাজশাহী নগরীর টিকাপাড়ায় বাস করতেন। তার একমাত্র ছেলে রাকিবুল ইসলাম লিটন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। বুধবার রাত ৮টার দিকে মৃত পারুল বেগমের মরদেহ তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। তবে মায়ের জানাজায় অংশ নেয়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছিলেন ছেলে রাকিবুল ইসলাম।

মায়ের মরদেহ দাফন শেষ করে এসে রাকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, তার মা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। কোমর থেকে বাম পা পুরোটাই ব্যথা ছিলো দুই দিন ধরে। সোমবার (৩১ আগস্ট) চিকিৎসক দেখানো হয়। রাতে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ঘুম হয়নি। ফজরের সময় বাবা-মা দুজনেই নামাজ পড়তে উঠেছিলেন। বাবা নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু মা নামাজ আদায় করতে পেরেছিলেন কি-না জানেন না। নামাজ শেষে মাকে বিছানায় অচেতন অবস্থায় পান বাবা। দ্রুত তাকে রামেক হাসপাতালে নেয়া হয়।

সকাল ৭টার মধ্যেই তাকে হাসপাতালের ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে নেয়া হয়। ওই সময় দায়িত্বরত চিকিৎসক কিছু ওষুধ লিখে দেন। তিনি দ্রুত সেই ওষুধ আনেন। ওষুধ এনে প্রায় ২০ মিনিট ধরে তিনি চিকিৎসক-নার্সদের খুঁজতে থাকেন। অনেক ডাকাডাকির পরও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। তারা জানান, এখন ডিউটি শিফট শেষ, তারা কিছুই করতে পারবেন না। এরই মধ্যে প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘসময় পর স্যালাইন-অক্সিজেন দেয়া হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মা মারা যান। বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি।

রাকিবুল ইসলাম জানান, ওই সময় কাউকে উদ্দেশ্য না করেই আক্ষেপ করে তিনি কিছু কথা বলেন। সঙ্গে থাকা স্বজনরা তাকে পরে শান্ত করেন। তখন সেখানে কোনো চিকিৎসক-কিংবা নার্স কেউ ছিলেন না। এরপর একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক তার কাছে আসেন। ওই সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, প্রয়োজনের সময় এলেন না, এখন কেন এলেন। পরে ওই চিকিৎসক পাল্টা প্রশ্ন তোলেন-কেন চিকিৎসকদের গালাগাল দেয়া হলো।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে ওই চিকিৎসক তাকে মারতে শুরু করেন। তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে ওই চিকিৎসক লাথি মারেন। এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। এরপর আনসার সদস্যরা তাকে আটকে ফেলেন। কিন্তু হামলাকারী চিকিৎসকদের আটকাননি তারা। পরে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক এসে তার ওপর আরেক দফা হামলা চালান। হামলার শিকার হন তার স্বজন ও সহকর্মীরাও। পরে তাকে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। সেখানেও হামলা চালানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। শেষে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, হামলার শিকার হয়েও আমি বিচার প্রার্থী হয়নি। উল্টো চিকিৎসকদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনন দাস জানান, পারুল বেগমের মৃত্যুর ঘটনায় তার ছেলে রাকিবুল চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে গালাগাল করছিলেন। প্রতিবাদ করলে চিকিৎসক শোভন ও রহিমের ওপর হামলা করেন তিনি। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে আটক করে নিয়ে যায়।

এমজে/