২০ নৌরুটের পলি অপসারণ, ড্রেজিংয়ে গচ্চা ৩০৮ কোটি টাকা

২০ নৌরুটের পলি অপসারণ, ড্রেজিংয়ে গচ্চা ৩০৮ কোটি টাকা

এবারের দফায় দফায় বন্যায় দেশের ২০টি ফেরি ও নৌরুটে আনুমানিক ১ কোটি ৭১ লাখ ঘনমিটার বাড়তি পলি জমেছে। এতে শুধু নদী ড্রেজিং কাজে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০৮ কোটি টাকা।

এ অর্থের পরিমাণ আরও বাড়বে। বাড়তি পলি জমায় পুরো টাকাই গচ্চা যাচ্ছে। অপরদিকে বন্যার তোড়ে শিমুলিয়াসহ কয়েকটি ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট ও এ সংক্রান্ত স্থাপনা ভাঙনে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির এ পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাড়তি ৪৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নৌ মন্ত্রণালয় সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

পলি জমায় শিমুলিয়া (মাওয়া)-ইলিয়াস আহমেদ (কাঁঠালবাড়ি) রুটে গত কয়েক মাস ধরেই ফেরি চলাচলে অচলাবস্থা তৈরি হয়। গত বুধবার ছয়টি ফেরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে।

কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল নৌ চ্যানেলটি বন্ধ হওয়ায় ফেরি চলাচল করছে না। এর আগেও কয়েক দফায় এ রুটে ফেরি বন্ধ ছিল। এতে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন দেয়ায় পলি জমার পরিমাণ নিয়ে কিছুটা হেরফের হতে পারে।

তবে এবার দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হওয়ায় নৌপথগুলোতে অতিরিক্ত পলি জমেছে। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ফেরি রুটে ১২টি ড্রেজার মোতায়েন ও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করে ফেরি চলার চ্যানেল উন্মুক্ত করার পরই তা আবার ভরে গেছে। আবার কাটা হচ্ছে আবার ভরে যাচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় ৩৯টি রুটে ২ কোটি ৪৫ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ লক্ষ্য নির্ধারিত রয়েছে।

এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার দিয়ে ১ কোটি ৩৪ লাখ ও বেসরকারি ড্রেজার দিয়ে ১ কোটি ১০ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণের কথা। এতে ব্যয় বরাদ্দ রয়েছে ১২৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

কিন্তু এবার দফায় দফায় বন্যায় অতিরিক্ত পলি জমেছে ১ কোটি ৭১ লাখ ঘন মিটার। প্রতি ঘনমিটার পলি অপসারণে ১৮০ টাকা ব্যয় হিসাবে ৩০৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা বেশি লাগছে।

বিআইডব্লিউটিএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মাওয়া-কাঁঠালবাড়ি ফেরি রুটে ১৫ লাখ ঘনমিটার বাড়তি পলি জমেছে। এ রুটে ড্রেজিং কাজে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২৭ কোটি টাকা।

এ পর্যন্ত এ ঘাটে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে ১০ লাখ ঘনমিটার বাড়তি পলি জমেছে।

এছাড়া লাহারহাট-ভেদুরিয়া ফেরি রুটে ৫ লাখ ঘনমিটার, হরিণা-আলুবাজার রুটে ৪ লাখ ঘনমিটার, বগা-ঝিলনা-পটুয়াখালী নৌরুটে ১০ লাখ ঘনমিটার, সুরমা নদীর ভৈরব-ছাতকে ১০ লাখ ঘনমিটার, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতে ২১ লাখ ঘনমিটার ও খুলনা-নওয়াপাড়া নৌরুটে ১০ লাখ ঘনমিটার বাড়তি পলি জমেছে।

এছাড়া ধলেশ্বরী নদীর হাজরাপুর-জোবরা, মাদারীপুর, কুড়িগ্রাম, ভোলাসহ বিভিন্ন নৌরুটে বাকি পলি জমেছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা অব্যাহত রয়েছে। মধ্য আগস্টে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখ করা হয়।

এখন ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। বাড়তি হিসাবও নতুন করে করা হয়নি। এছাড়া বর্ষার এ ভরা মৌসুমেও ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-সিলেটসহ বিভিন্ন নৌরুটে নাব্য সংকট রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক লঞ্চ ও কার্গো জাহাজ মালিক।

তাদের কেউ কেউ ড্রেজিং কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এ খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে কয়েকটি স্থানে ড্রেজিংয়ের বালি চ্যানেলেরর কাছেই ফেলা হচ্ছে। ফলে পানি স্রোত ও ঢেউয়ে এগুলো ফের জমা হচ্ছে নৌরুটে।

এতে প্রায় প্রতি বছরই ড্রেজিংয়ের নামে বারবার একই বালি সরিয়ে নৌপথের নাব্য ঠিক রাখতে গিয়ে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে মোটা অংকের অর্থ।

এ প্রসঙ্গে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক প্রফেসর একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ড্রেজিং কার্যক্রমের মনিটরিং করা হলে এ ধরনের অভিযোগ আসবে না।

রুট সম্পর্কে ভালোভাবে স্টাডি করে প্রকৃত মেজারমেন্ট নিয়ে নদী খনন করতে হবে। এছাড়া খনন এলাকার কাছাকাছি ড্রেজিং স্পয়েল ফেলা যাবে না। এতে এক বছরের মধ্যে তা আবার নদীতে চলে আসে।

তিনি বলেন, এবার ৪০ দিনের বেশি দীর্ঘমেয়াদে বন্যা হওয়ায় নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হবে। উজান থেকে আসা পলি এবং দেশের ভেতরের নদী ভাঙনের মাটি দুইয়ে মিলে নদীতে বেশি পলি জমবে- এটাই স্বাভাবিক।

বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদন : জানা গেছে, চলতি বন্যা ও করোনায় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ উল্লেখ করে ১৬ আগস্ট প্রতিবেদন নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

সংস্থাটির সচিব মুহম্মদ আবু জাফর হাওলাদার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে চলতি বন্যাকে ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে ওই সময় পর্যন্ত ২০টি ফেরি ও নৌরুটে ১ কোটি ৭১ লাখ ঘনমিটার বাড়তি পলি জমেছে বলে দাবি করা হয়েছে।

যদিও পলি জমার এই হারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০টি রুটে পলি জমার কথা উল্লেখ করলেও সব রুটে বন্যার আগে ও পরে সার্ভে করেনি সংস্থাটি হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ।

কয়েকটি রুটের সার্ভে রিপোর্টের ভিত্তিতে গড় হিসাবে অন্যান্য রুটের পলি জমার পরিমাণ জানিয়েছে সংস্থাটি।

ফেরি ও লঞ্চ ঘাটের ক্ষতি ৪৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা : ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যায় শিমুলিয়া ও কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাট, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, বাঘাবাড়ী নদী বন্দরসহ কয়েকটি ঘাট ও বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এতে বিআইডব্লিউটিএর ক্ষতি হয়েছে ৪৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্রোতের তোড়ে শুধু শিমুলিয়া ফেরিঘাটসংলগ্ন ৬৬ হাজার বর্গফুট বা ৩ একর জমি নদীতে ডুবে গেছে।

২৮ জুলাই ৩ নম্বর ফেরিঘাট ও ৬ আগস্ট ভিআইপি ঘাটসংলগ্ন এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এতে ফেরিঘাটের অ্যাপ্রোচ সড়ক, পার্কিং ইয়ার্ড, যাত্রী ছাউনিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ডুবে যায়। জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে এ ঘাটের ভাঙন সামাল দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ।

বিআইডব্লিউটিএ প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ফেরিঘাট, অ্যাপ্রোচ রোড, জেটি, গ্যাংওয়েসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৩ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং বাঘাবাড়ি নদী বন্দর এলাকায় তীররক্ষা ও আরসিসি গাইড ওয়ালের ক্ষতি ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা হয়েছে বলে জানিয়েছে। বাকি ক্ষয়ক্ষতি অন্যান্য খাতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।

এমজে/