উত্তরে ফের ব্যাপক বন্যা, বিপাকে দুর্গতরা

উত্তরে ফের ব্যাপক বন্যা, বিপাকে দুর্গতরা

উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নদনদীর পানি বৃদ্ধিতে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার ফলে বাড়ছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। গত কয়েক দিনে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় আবারও বাঁধ ও সড়ক ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ভাষ্য, উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বৃষ্টি যোগ হয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে দুই থেকে তিন দিনের একটি বন্যার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সাত দিন ধরেই বন্যার পানি উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে, এখন যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ছোট যমুনা, ঘাঘট, পদ্মা, ধলেশ্বরী, যমুনা ও আত্রাইয়ের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম থেকে বগুড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যার পানি যমুনা ও পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে। আর পথে পদ্মা ও যমুনার দুই পাড়ে তীব্র ভাঙনের সৃষ্টি করছে।

বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

শুক্রবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান।

যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলের চালুয়াবাড়ী, কর্নিবাড়ী, কুতুবপুর, চন্দনবাইশা, কাজলা, কামালপুর ও সারিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলগুলো এবং এসব এলাকার রোপা আউশ, মাষকলাই, মরিচ, স্থানীয় জাতের গাঞ্জিয়া ধানসহ ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি কমে আবার বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, যমুনা নদীতে বিপদসীমা নির্ধারণ করা হয় ১৬ দশমিক ৭০ মিটার।

জানা যায়, গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে গাইবান্ধার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শুধু তিস্তা নদী বাদে বেড়েছে করতোয়া, ঘাঘট নদীসহ ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। এদিকে নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা। এতে করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব উপজেলার ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। বন্যার কারণে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। ফলে যাতায়াতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস্য প্রকল্পের মাছ। এ অবস্থায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও গো-খাদ্যের। পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জে ভেঙে যাওয়া বাঁধের অংশ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হচ্ছে আরও নতুন নতুন এলাকা। জলমগ্ন হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার মানুষ। তলিয়ে গেছে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কও। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙন। নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, শুক্রবার বিকেল ৩টায় করতোয়া নদীর পানি গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী পয়েন্টে বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার উপরে, ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৭ সেন্টিমিটার উপরে ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়িঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

এদিকে ধরলার পানি নেমে যাওয়ার পর, এবার বিপদসীমা অতিক্রম করেছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। দীর্ঘতম এ বন্যায় কুড়িগ্রামের ৬ লক্ষাধিক মানুষ তাদের ফসল, ভিটেমাটি, জমি, জমানো টাকা আর মজুদ খাবারসহ সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। এরই মধ্যে নতুন করে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে যাওয়ায় চিলমারী, উলিপুর, রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার কয়েকশ’ গ্রামের নিম্নাঞ্চল আবার প্লাবিত হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে বিকেল ৩টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে ১ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার রাত ২টার দিকে পানির তীব্র স্রোতে পৌর এলাকার শোলাকুড়া মহল্লায় সিংড়া বলিয়াবাড়ি রাস্তার বাঁধ ভেঙে যায়। এতে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মহেশচন্দ্রপুরসহ কয়েকটি মহল্লার হাজার হাজার মানুষ। গত বৃহস্পতিবার সকালে নাগর নদের হিয়াতপুর নামক স্থানে সিংড়া-তাজপুর সড়ক ভেঙে যায়। এতে ওই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। উপজেলার ২ হাজার ৭৭৬ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ১ হাজার ৩০০ পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। পানিবন্দি হয়েছে অন্তত এক লাখ মানুষ। নিরুপায় হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ছুটছেন বন্যাদুর্গত মানুষরা। ইতিমধ্যে ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

এছাড়া কয়েক দিন ধরে সিরাজগঞ্জ ও কাজীপুর পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে কাজীপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে যমুনা তীরবর্তী চর এলাকার মানুষ বিশেষ করে কৃষকরা আবারও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, টানা বর্ষণের কারণে যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

এমজে/