ধরা পড়ার পর এসআই আকবর

‘মুঝে জান ভিক্ষা দে না ভাই...’

‘মুঝে জান ভিক্ষা দে না ভাই...’

দুই হাত পেছনে বাঁধা। দুই পাশে সাদা দুটি গাড়ি। মাঝখানে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁঞা। তাঁকে ঘিরে আছেন ৭ থেকে ৮ জন যুবক। হিন্দি ও খাসি ভাষাতে কথা বলছেন সবাই। আকবরকে নানা রকম প্রশ্নও জিজ্ঞেস করছেন তাঁরা। এর মধ্যে হঠাৎ আর্তি জানিয়ে আকবর বলেন, ‘মুঝে জান ভিক্ষা দে না ভাই...।’

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে মো. রায়হান আহমদ (৩৪) নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে পলাতক পুলিশের বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁঞাকে ধরার সময়ের আরেকটি ভিডিও পাওয়া গেছে। এতে আকবরকে ধরে রাখা ৭-৮ জন যুবককে খাসি ও হিন্দি ভাষার মিশেলে কথা বলতে শোনা গেছে। আকবরও তখন তাঁদের সুরে কথা বলার চেষ্টা করেন। প্রায় ২ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড স্থায়ী এই ভিডিওতে আকবর নিজেকে ‘কুমার দেব’ বলে পরিচয় দেন। ‘গোপাল খা’ নামে তাঁর এক ভাই আছে জানিয়ে তাঁর মুঠোফোনে কল করার আকুতি জানান। শুরুতে আকবর হিন্দি ও খাসি ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেন। তবে শেষে বাংলায় কথা বলা শুরু করেন। রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ফাঁড়িতে কী হয়েছিল, তাঁরও কিছু বর্ণনা দেন।

ভিডিওতে দেখা গেছে, পুরো এলাকা পাহাড়, বন ও ঝোপঝাড়বেষ্টিত। দুই পাশে দুটি সাদা রঙের গাড়ি দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, গাড়ি দুটি দিয়ে আকবরকে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্ত অঞ্চল ডোনা এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ২ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড স্থায়ী ভিডিওতে আকবরকে সন্ত্রস্ত অবস্থায় একাধিকবার ‘মুঝে জান ভিক্ষা দে না ভাই’ বলে আকুতি জানাতে শোনা গেছে। আকবরকে ঘিরে রাখা যুবকেরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁকে আঘাত করছিলেন।

আকবরের মুখে এ রকম আর্তনাদ শুনে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘হাম লোক কিয়া ফয়সালা করেগা, ওদার ফয়সালা করে গা...।’ তখন আকবর বলেন, ‘গোপাল খাকে ফোন দে না।’ গোপাল কে? জানতে চাওয়ায় আকবর বলেন, ‘মেরা ভাই গোপাল খা।’ এ কথা বলে আকবর আবারও বলে ওঠেন, ‘মুঝে জান ভিক্ষা দে ভাই।’ তখন ‘চুপ থাক’ বলে তাঁকে শাসানো হয়।

এরপর যুবকদের একজন আকবরকে বলেন, ‘তুম কিয়া কিয়া, মুঝে ঠিকসে বাতাও।’ আকবর তখন খাসিয়াদের ভাষা বোঝেন না জানিয়ে বলেন, ‘হিন্দি মুঝে লিটল আঁতি হে। বাংলা আথি হে।’ তখন আকবরকে বলা হয়, ‘বাংলা আতাও’। আকবরকে তখন চুপ থাকতে দেখা যায়। দড়ি এনে বেঁধে ফেলার কথা বলে ‌‘ওদার ফয়সালা’ বলে আকবরকে সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলা হয়।

সিলেট নগরীর আখালিয়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরের দিন ১১ অক্টোবর মারা যান রায়হান। এ ঘটনায় রাতে কোতোয়ালি থানায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা হয়। ১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা আকবর সাময়িক বরখাস্ত হন। ১৩ অক্টোবর থেকে আকবরকে পাওয়া যায়নি। ২৭ দিন পর রোববার ধরা পড়ার পর আকবরকে একটি ভিডিওতে বলতে শোনা গেছে, তিনি কানাইঘাটের সুরইঘাট দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধরা পড়ার সময় আকবরের মুখে দাড়ি, গলায় পুঁথির মালাসহ বেশভূষায় ‘খাসিয়া’ সাজ ছিল।

পুলিশ ও কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকার মানুষজন এই ভিডিও দেখে ধারণা করছেন, এটি প্রথম দিকের ঘটনা। আকবরকে সাদা গাড়ি দিয়ে সেখানে নিয়ে আসা হয়। যাঁরা আকবরকে সেখানে নিয়ে যান, তাঁরা আকবরকে জিজ্ঞাসা করে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের কাহিনি জানতে চেয়েছিলেন।

খাসিয়াপল্লিতে যাতায়াত আছে, ডোনা সীমান্তের একটি গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দা ভিডিওটি দেখে বলেন, ডোনা সীমান্তের ওপারে ভারতের তিজাঙ্ঘা। ওই এলাকা পুরোটা খাসিয়াপল্লি। মেঘালয় থেকে সরাসরি গাড়ির যোগাযোগ রয়েছে সেখানে।

কানাইঘাট থানা-পুলিশ ও সীমান্ত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সূত্র বলছে, আকবরকে পুলিশে সোপর্দ করার আগে ছয়টি ভিডিও ছড়িয়েছে। এর মধ্যে আকবরকে খাসি ও হিন্দি ভাষার মিশেলে কথা বলতে শোনা গেছে শুধু প্রথম দিকের ওই ভিডিওতে। সব ভিডিও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যবেক্ষণ করছে।

এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার রাতে জেলা পুলিশের সংবাদ ব্রিফিংয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আকবরকে সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করেছি। কিছু ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। সেই সব ভিডিও আমি নিজেও দেখিনি। এসব ভিডিও দেখে পলাতক থাকাকালে আকবরের অবস্থান কোথায় কোথায় ছিল, তা বের করা হবে।’