সড়কের দ্বিগুণ খরচ ড্রেনে

সড়কের দ্বিগুণ খরচ ড্রেনে

সরকার উন্নয়নের ছোঁয়া সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও প্রকল্প অনুমোদন করছে। কিন্তু এসব কাজের ক্ষেত্রে ব্যয়ের হিসাব নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা ও প্রশ্ন অব্যাহত রয়েছে। উন্নয়নকাজের ব্যয়গুলোকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা যাচ্ছে না। প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে সড়ক নির্মাণের চেয়ে সড়কের ড্রেন নির্মাণ খরচ দ্বিগুণ। আবার ফুটপাথের পেছনেও যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা-ও সড়কের চেয়ে বেশি।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার আরসিসি পাইপ ড্রেন নির্মাণ খরচ চার কোটি টাকা এবং আরসিসি সড়ক নির্মাণ খরচ ১.৯৬ কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) আজ প্রশ্নটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে একনেক সূত্রে জানা গেছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের দেয়া প্রস্তাবনার তথ্য অনুযায়ী, এই সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার আগে বিলুপ্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার আয়তন ছিল ২১ দশমিক ৭৩ বর্গকিলোমিটার। সে সময় ওয়ার্ড ছিল ২১টি। আর জনসংখ্যা প্রায় চার লাখ। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর সিটি করপোরেশন স্বীকৃতিতে আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় চার গুণের বেশি অর্থাৎ ৯০ দশমিক ১৭ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এই সিটিতে ওয়ার্ড সংখ্যা ৩৩টি এবং জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় আট লাখ।

ফলে অবকাঠামো উন্নয়নসহ জনগণের সেবার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নগরীর সম্প্রসারিত এলাকায় নতুন সড়ক ও ড্রেন নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ ছাড়াও ব্রিজ, কালভার্ট, ফুটপাথ ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণের মাধ্যমে এই সিটির নাগরিক সেবা বাড়াতে ১৫ শ’ ৭৫ কোটি ছয় লাখ ২৯ হাজার টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এখানে এক হাজার ৪১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা সরকারি অর্থায়ন, বাকি ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা হলো সংস্থার নিজের। চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

প্রকল্প প্রস্তাবনার চাহিদার তালিকা অনুযায়ী, এখানে মূল কার্যক্রম হলো, নতুন ও পুরনো এসব চাহিদা পূরণে প্রকল্পের অধীনে ৪৭৪ দশমিক ৮২ কিলোমিটার বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ, ৩৪৫ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার বিভিন্ন ধরনের ড্রেন নির্মাণ ও ১৬ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণকাজ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ৩৭ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল ও ১ দশমিক ১০ কিলোমিটার রোড ডিভাইডার নির্মাণ, তিনটি ব্রিজ নির্মাণ, ১৩টি কালভার্ট ও ছয়টি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের কাজ। এ ছাড়া দু’টি ওয়াটার ব্রাউজার, একটি এস্কেভেটর, দু’টি মিনি এস্কেভেটর, একটি অটোমেটিক পটহোলস রিপেয়ার মেশিন, একটি চেইন ডোজার, দু’টি রেডি মিক্স কংক্রিট ক্যারিয়ার, দু’টি ডাম্প ট্রাক এবং এক সেট অটোমেটিক ভেহিক্যাল ওয়াশ মেশিনসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী কেনা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।

প্রকল্পের ব্যয়ের হিসাব থেকে দেখা যায়, কার্পেটিং সড়ক নির্মাণ করা হবে ১৯৪.৭৪ কিলোমিটার। যার জন্য খরচ হবে ২৯১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ খরচ এক কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার টাকা। ২৭৩.৬৫ কিলোমিটার আরসিসি সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে এক কোটি ৯৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। প্রকল্পে পৌনে ১০ কিলোমিটার আরসিসি পাইপ ড্রেন নির্মাণ করা হবে ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকায়। ফলে কিলোমিটারে খরচ হবে চার কোটি চার লাখ টাকা।

আরসিসি ড্রেন নির্মাণ করা হবে ৫৩২ কোটি ৭৯ লাখ টাকায় ৩২১ দশমিক ৬১ কিলোমিটার। এখানে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়বে এক কোটি ৬৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া আড়াই কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণ করতে খরচ ধরা হয়েছে তিন কোটি টাকা। ফলে কিলোমিটারে ব্যয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। আর ১৫.১৭ কিলোমিটার পাইপ ড্রেনসহ ফুটপাথ নির্মাণে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে দুই কোটি ৪৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।

তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৩৮ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪২ কোটি ২৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর ৬২ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অন্য দিকে, ফুটপাথ উন্নয়নে কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হযেছে ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

এই ব্যয়ের যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, রেট শিডিউলের কারণে পার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু এতটা হেরফেরের কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না। তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো ব্যাখ্যা থাকলে সেটি আমার কাছে নেই।

এমজে/