স্কুল বন্ধে ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ হচ্ছে না

স্কুল বন্ধে ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ হচ্ছে না

করোনায় দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ হচ্ছে না। অন্য দিকে ক্লাসের উপস্থিতির বাইরে অনলাইন কিংবা দূরশিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পঠনের মধ্যেও আনা যাচ্ছে না। ফলে বাস্তবতার আলোকে বিশ্বের ১৯১ দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর পরিচালিত গবেষণায় স্কুল খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে ইউনিসেফ। সম্প্রতি সংস্থাটি বলেছে শিশুদের যথাসম্ভব নিরাপদে রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্কুল খুলে দেয়া যেতে পারে। একই সাথে বিভিন্ন দেশের সরকারকে বিষয়টির প্রতি নজর দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের শিশু সহায়তা তহবিল ইউনিসেফ।

এ দিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও স্কুল খুলে দেয়ার দাবি দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পড়েছে সঙ্কটে। ইতোমধ্যে ৪০ হাজার বেসরকারি স্কুল তথা কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ঝরে পড়বে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী। বেকার হবে লক্ষাধিক শিক্ষক।

ইতোমধ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল কলেজ খুলে দেয়ার জন্য। তারা বারবারই বলছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে। সরকারের একজন উপমন্ত্রী এটাও বলেছেন, স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বিগত ১০-১১ বছরে শিক্ষা খাতের যে সুনাম ও অর্জন ছিল দীর্ঘ ৯-১০ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় এখন সেটাও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

গত ৮ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কুল বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণে অগ্রগতি এবং সার্বিক কল্যাণে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সংস্থাটির দেয়া তথ্য অনুসারে, গত ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রতি পাঁচজন স্কুলগামী শিশুর মধ্যে প্রায় একজনের বা মোট ৩২ কোটি শিশুর ক্লাস বন্ধ রয়েছে, যা গত ১ নভেম্বরের ২৩ কোটি ২০ লাখের চেয়ে প্রায় ৯ কোটি বেশি। বিশ্বের ১৯১টি দেশ থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ব্যবহারের মাধ্যমে করা সাম্প্রতিক এক বৈশ্বিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্কুল খোলা বা বন্ধ যা-ই থাকুক না কেন, তার সাথে করোনা সংক্রমণ হারের কোনো সম্পর্ক নেই।

প্রতিবেদনে ইউনিসেফ শিক্ষা কার্যক্রমের বৈশ্বিক প্রধান রবার্ট জেনকিনস জানান, তথ্য-প্রমাণ বলছে, স্কুলগুলো এই মহামারীর প্রধান চালিকাশক্তি নয়। তা সত্ত্বেও দেশে দেশে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে এবং এর ফলে অব্যাহতভাবে শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা ও সুরক্ষার ওপর ভয়াবহ রকমের প্রভাব পড়ছে। স্কুলগুলো থেকে ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ ছড়ানোর খুব কমই তথ্য আছে এবং এ অবস্থায় স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দেয়াকে অগাধিকার দেয়া এবং শিশুদের যথাসম্ভব নিরাপদে রাখার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে ইউনিসেফ সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, করোনা সংক্রমণের কারণে প্রায় ১০ মাস ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে শিক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়া কমানো, ভর্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব অর্জন হয়েছিল; দীর্ঘ বন্ধের কারণে সেগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে স্কুল খোলা দরকার। আবার করোনা সংক্রমণের বাস্তবতাও আছে। তাই স্কুল খোলার আগে অবশ্যই ভেবেচিন্তে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে পরিবেশ নিরাপদ করতে হবে।

করোনাকালে স্কুল বন্ধ ও এর প্রভাব নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, করোনা সংক্রমণের কারণে শিক্ষা খাতের অনেকগুলো অর্জন হুমকির সম্মুখীন। গত ১১ বছরের অনেক অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শিক্ষা প্রসারের কারণে বাল্যবিবাহ কমানোসহ নারীর উন্নয়ন হয়েছে। এসব অর্জন যাতে ধূলিসাৎ না হয়, সে জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা নিতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ভেবেচিন্তে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে স্কুল খুলতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সবার কথা বিবেচনায় রেখেই ঝুঁকি প্রশমন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। এ জন্য স্কুলগুলোকে সেভাবে প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তথ্যউপাত্ত ঠিকভাবে সংগ্রহ করা। কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে বা পিছিয়ে আছে, সেগুলো জানাও জরুরি। সরকারের কাছে অনুরোধ রেখে রাশেদা কে চৌধুরী আরো বলেন, পুনরায় স্কুল খোলার সময় উৎসব করা দরকার। যেন সবার কাছে এই বার্তা যায় যে স্কুলগুলো প্রস্তুত। সবাই যাতে আস্থা ফিরে পায়, সে রকম বার্তা দিতে হবে।

করোনার কারণে শিশুদের ওপর প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে ইউনিসেফের শিক্ষা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহসীন বলেন, শিশুদের ‘আর্লি লার্নিং ক্যাপাসিটি’ (প্রারম্ভিক শিখন যোগ্যতা) যথাযথ না হলে তা সারা জীবনে পূরণ হওয়ার নয়। পুনরায় স্কুল খোলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে স্কুল চালু করলেও অনলাইনে পড়াশোনার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। এমনও হতে পারে যে সপ্তাহে তিন দিন সশরীরে এবং তিন দিন অনলাইনে ক্লাস নেয়া হলো। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক ও মালিকরা। একই সাথে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি স্কুল তথা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের আর্থিক সহায়তা দেয়ারও দাবি জানান তারা।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল রাহার চৌধুরী জানান, আমরা মালিক ও শিক্ষকরা গত ১৭ মার্চ সরকারের ঘোষণার সাথে সাথে কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করি। সেই সময় থেকে দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস আজো বন্ধ আছে। আর কত দিন বন্ধ থাকবে সেটাও আমাদের জানা নেই। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফির ওপর নিভর্রশীল এবং ৯৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফিতে ৪০ শতাংশ বাড়িভাড়া, ৪০ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বাকি ২০ শতাংশ গ্যাস বিল, বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ অন্যান্য খরচ নির্বাহ না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিতে হয়। তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানান।

এমজে/