রোহিঙ্গাদের ফেরাতে অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করছে মিয়ানমার

রোহিঙ্গাদের ফেরাতে অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করছে মিয়ানমার

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সরকার এখনো আশাবাদী।

কারণ হিসেবে মন্ত্রী বলেন, এ ইস্যু নিয়ে সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কথা বলেছে। সবাই স্বীকার করেছে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। তাই সমস্যার সমাধানও করতে হবে তাদের। আর রোহিঙ্গাদের সেদেশে স্থায়ীভাবে ফিরিয়ে নেওয়াটাই হবে স্থায়ী সমাধান।

তিনি আরও বলেন, আমেরিকা-ইউরোপ সবাই একবাক্যে বলছে, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেই হবে। যদিও মিয়ানামার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না সেটা বলছে না। কখনো নির্বাচন, কখনো করোনা- এসব অজুহাত সামনে এনে সময়ক্ষেপণ করছে।

রোববার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম রচিত ‘রোহিঙ্গা নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতি গোষ্ঠী’ ও ‘শেষ সীমান্তের পর কোথায় যাব আমরা’ এই দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবদুল মোমেন এসব কথা বলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা-উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

মুখ্য আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার অনারারি কনসাল মো. মহসিন ও সুপ্রভাত বাংলাদেশ সম্পাদক রুশো মাহমুদ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রকাশনা সংস্থা খড়িমাটির মনিরুল মনির।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাকের ১০ লাখ বাস্তুহারা মানুষকে জায়গা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে ইউরোপের ২৭টি দেশ। আর বাংলাদেশ ১১ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিকতার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। প্রথম দিকে বিদেশিরা কেউ সাহায্য করেনি। এখানকার লোকজন তাদের ঠাঁই দিয়েছেন, খাবার দিয়ে সাহায্য করেছেন। আমরা এটি নতুন আদর্শ সৃষ্টি করেছি। বাঙালিরা মানুষ, তারা মানুষকে মানবিকতার চোখে দেখে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এর উৎকৃষ্ঠ প্রমাণ।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। মিয়ানমার প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা বারবার বলছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবে ভেরিফিকেশন করার পর। তারা কখনো বলেনি, রোহিঙ্গাদের নেবে না। আমরা বলেছি, তাদের নিয়ে যাও। তবে ‘ইউ মাস্ট এনসিউর সিকিউরিটি অ্যান্ড সেফটি’। তারা অঙ্গীকার করেছে নিয়ে যাবে। কিন্তু এরপরও আজ প্রায় সাড়ে ৩ বছরে একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি। গত বছরের ২০ জানুয়ারি মিয়ানমারের সঙ্গে বড় সভা হয় এ ইস্যুতে। এরপর কোভিড ও ইলেকশনের বাহানা দিয়ে তারা আর সভা করেনি। আমরা আশা করছি, নতুন করে তাদের সঙ্গে বসবো। রোববারও মিয়ানমারের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জানান মন্ত্রী।

মন্ত্রী বলেন, ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। ১৯৯২ সালে প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। পরবর্তীতে আলোচনা মাধ্যমে তারা ২ লাখ ৩০ হাজারকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যেহেতু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার রেকর্ড আছে তাই আমরা আশাবাদী সর্বশেষ আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকেও তারা ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কখন নিয়ে যাবে সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বাংলাদেশ সরকার সে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।

একে মোমেন আরও বলেন, আমরা মিয়ানমারকে বলেছি- তোমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদেরও উন্নয়ন হচ্ছে। তোমাদের এ লোকগুলো নিয়ে যাও। যদি না নিয়ে যাও, তাহলে এই এলাকায় অশান্তি সৃষ্টি হবে। অশান্তি দেখা দিলে, তোমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে আমাদেরও উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য তাদের নিয়ে যাও। কিন্তু তারা নিয়ে যায়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করে না। তাই তারা সে দেশে ফিরতে চায় না। এ জন্য আমরা তিনটি প্রস্তাব দিয়েছি মিয়ানমারকে। সরকারের নেতাদের এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি। তারা একবার এসেছিল, কিন্তু প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে ফিরে গেছে। আরও বলেছি, রোহিঙ্গা মাঝিদের নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করাও। তারা কোনো উত্তর দেয়নি। তোমাদের সরকারকে যেহেতু বিশ্বাস করে না, তাই তোমরা নন-মিলিটারিস সিভিলিয়ানকে রাখাইনে রাখো। তাহলে আমরা বলবো, সেখানে তৃতীয় পক্ষ আছে তোমরা (রোহিঙ্গা) যাও কোনো অসুবিধা হবে না। তারা সেটিও মানেনি। হ্যাঁ বা না কোনোটি বলেনি।

কৌশলগত কারণে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের পক্ষে থাকেনি উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে আন্তর্জাতিক ফোরামেও কথা বলা হচ্ছে। ১৩২টি দেশ আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য এই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। সম্প্রতি জাপানও আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছে। জাপানে মিয়ানমারের অনেক শ্রমিক আছে। তারাও উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমারকে বোঝানোর। আমরা সবসময় আশাবাদী। সবসময় বিশ্বাস করি, আলোচনার মধ্যে সমাধান আসবে।

তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে একটি মডেল সৃষ্টি করেছি। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের লেখালেখি করা উচিত। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বড় বড় সমস্যা সমাধান করেছে।

পৃথিবীর একজন মানুষও রাষ্ট্রবিহীন থাকা উচিত না মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আল্লাহ পৃথিবীটা সৃষ্টি করেছেন সবার জন্য। আমরা রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছি। বিশ্বের কোথাও একজন মানুষও রাষ্ট্রবিহীন থাকুক এটা চাই না। এ জন্য গ্লোবাল ঐকমত্য দরকার।