স্বাধীনতার ৫০ বছর; বিশেষজ্ঞ মত

বিভাজন বেড়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি গণতন্ত্র

বিভাজন বেড়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি গণতন্ত্র

বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে উপনীত হয়েছে। বর্ণাঢ্য আয়োজনে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন হচ্ছে। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রধানদের কেউ কেউ এ সময়ে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করছেন। দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি দেখে তাদের কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত।

তবে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ এ পথপরিক্রমায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেমন এক দিকে দেশের মানুষ অনেক কিছু পেয়েছে আবার অন্য দিকে আশাহত হওয়ার মতো ঘটনাও নেহায়েত কম নয়। এই দেশটাকে যারা গড়বেন সেই রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মধ্যকার বিভাজন চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি আস্থার সঙ্কট ও অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি হয়েছে। যার ফলে অর্ধশতাব্দিতেও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এই সঙ্কটের নিরসন না হলে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করা সম্ভব নয়। ফলে মৌলিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়ে গেছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে যদি অর্জনের দিক বলা হয়, তাহলে আমরা অনেক এগিয়েছি। অর্থনৈতিক সূচকে, মানবোন্নয়ন সূচকে, অবকাঠামো দিক দিয়ে উন্নতি হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে আমাদের অগ্রগতি বেশি আছে। তবে এসব উন্নয়নে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলার মতো কিছু দেখি না। আবার অনেক কিছুই অর্জন করার মতো ছিল তা আমরা পারিনি। তার মধ্যে যেমন স্বাধীনতার এই ৫০ বছরেও এসে দেখি অনেক অসহায় গরিব মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাতছে, প্রতিটি বিভাগে দুর্নীতি বেড়েছে, বিদেশে অর্থপাচার বেড়েছে, লুটপাট বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবাধ তার অবক্ষয় ঘটেছে। মানুষের বাকস্বাধীনতা অনেকক্ষেত্রে রুদ্ধ হয়েছে, ভোটাধিকার হরণ হয়েছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতো আছেই। যেসব ভিত্তির উপর একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে তার মূল অনুষঙ্গগুলোই আজ অনুপস্থিত। এখনো দেশের মানুষ শান্তির সুবাতাস খুঁজে বেড়ায়- এটা আমাদের জন্য বড় দুর্ভাগ্য।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে আমাদের অনেক উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়েছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্টসহ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বলা যায়, স্বাধীনতার পর একটি ধ্বংসস্তুপ জাতি থেকে একটি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে।

যারা অতীতে বলেছে তলাবিহীন ঝুড়ি এখন তারাও এ দেশের উন্নয়নের প্রশংসা করে। আওয়ামী লীগ গত এক যুগ টানা ক্ষমতায় রয়েছে বলে এগুলো সম্ভব হয়েছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে আমরা এত দিনে উন্নত দেশের কাতারে চলে যেতাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই এ দেশে রাজনৈতিক বিভাজন শুরু হয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে এটা কালচার হয়ে গেছে। সব কিছুর বিরোধিতা করতেই হবে। এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। তবে সহসায় এটা হবে বলে আমার মনে হয় না।

অ্যাডভোকেট হুমায়ুন বলেন, রাজনৈতিক বিভাজন যদি না থাকত তাহলে আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। যেমন গণতন্ত্রকে আমরা এখনো সুসংহত করতে পারেনি। অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ে তুলতে পারেনি। এখনো সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অর্থনৈতিক সূচকে দেশ অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। মানবোন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি নিয়ে অনেকেই ঈর্ষা করে। উন্নয়ন মানেই যদি অবকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি বুঝি তাহলে এগুলোর দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। তিনি বলেন, মানুষ তো শুধু তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হলে, খাওয়া পরা হলেই বেঁচে থাকতে পারে না, মানুষের জন্য কতকগুলো স্বাধীনতা দরকার। যেমনÑ বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি। এগুলো না থাকলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। এসব দিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নে এগিয়ে গেলেও আমরা গণতান্ত্রিক সূচকে পিছিয়ে পড়ছি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে দেখতে হচ্ছে দমন-পীড়ন, বাকস্বাধীনতাহরণ, ভোটাধিকার হরণ- এগুলো আমাদের দুর্ভাগ্য। রাজনৈতিক বিভাজনটা অনেক বেড়ে গেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রাপ্তি একেবারে কম না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে, অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে আমাদের বড় বড় অর্জন আছে। কিছু ক্ষেত্রে আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি, কিছু ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছি। কিন্তু যে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি তাহলো, মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যতা বেড়েছে, দুর্নীতি বেড়েছে, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম হচ্ছে, টাকা লুটপাট হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এর ফলে আমাদের অনেক ভালো ভালো অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ড. তারেক বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে দেখি রাজনৈতিক বিভাজনটা অনেক বেশি। এটা দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ইস্যুতে একটা সহাবস্থান প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ডিভিশনটা এখনো আমাদের লক্ষ্যমাত্রাকে পিছিয়ে দিচ্ছে, অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশাটাকে ফিকে করে ফেলছে।

৫০ বছরে এসে এটা হওয়া উচিত না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে ওঠা প্রয়োজন। পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস যদি না থাকে তাহলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। গণতন্ত্রের মানেই হচ্ছে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া। এই আস্থার ঘাটতি আমাদের অর্জনটাকে ম্লান করে দেয়।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ঘাম শ্রমের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তারপরই আমাদের মূলত স্বপ্ন দেখা শুরু। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরে সেই স্বপ্নের ওপর একটার পর একটা আঘাত আসতে শুরু করল। গণতন্ত্রের ওপর, সংবাদ পত্রের ওপর আঘাতে মানুষ আশাহত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সত্যিকার অর্থে আজ পর্যন্ত স্বাধীন হওয়ার পর যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল মানুষ, যেমন একটি ধারাবাহিক গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার, সুশাসন, সবার জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি, এগুলো সংবিধানে লেখা আছে। কিন্তু আমরা তার ধারে কাছেও নেই। আর এখন স্বপ্ন বলতে যদি আমরা কিছু রাস্তা কিছু ব্রিজ, কালভার্ট, পুল ইত্যাদি কিছু স্ট্যাকচারাল ডিজাইন বুঝি তাহলে অনেক হয়েছে।

তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবে মানুষকে যে স্বপ্নগুলো দেখানো হয়েছে তা বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য শুধু রাজনৈতিক বিভাজন এককভাবে দায়ী নয়, এখানে অনেক অনুষঙ্গ দায়ী।

যখন থেকে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের মত দেশ গড়ে উঠেছে তখন থেকে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যে ধরনের শিক্ষা ও দেশপ্রেম, যে ধরনের আত্মত্যাগ, সততা, নিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতা থাকা দরকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা কখনোই ছিল না। যার ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আক্ষেপ করতে হয়।

এমজে/