মুখোমুখি তিন গ্রুপ

আসলামের চাঁদাবাজি সাম্রাজ্যের দখল ধরে রাখতে চায় পরিবার

আসলামের চাঁদাবাজি সাম্রাজ্যের দখল ধরে রাখতে চায় পরিবার

ঢাকা-১৪ আসনের সদ্যঃপ্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের পরিবার নিয়ন্ত্রিত চাঁদাবাজির বিশাল সাম্রাজ্য দখলে নিতে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে তিনটি গ্রুপ। এলাকায় বেড়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আনাগোনা। এলাকার নেতারা এ কারণে যেকোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন। আসলাম জীবিত থাকতে পুরো চাঁদা বাণিজ্য ছিল তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। এলাকায় তাদের অনুগত নেতারা চাঁদা তুলতেন এবং সংসদ সদস্য ও তাঁর পরিবারের লোকদের কাছে চাঁদার টাকা পৌঁছে দিয়ে নিজেরা কমিশন পেতেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা-১৪ আসনের শুধু বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ও শাহ আলী মাজারকেন্দ্রিক স্থাপনা থেকে দিনে প্রায় দুই কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। গত ১৪ এপ্রিল আসলামুল হকের মৃত্যুর পর চাঁদা আদায়কারী নেতারা হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করেছেন, আসলাম পরিবারকে দেওয়ার বদলে নিজেরাই এখন চাঁদার শতভাগ নিতে চান। আবার এত দিনে যাঁরা আসলামবিরোধী ছিলেন, চাঁদার বাণিজ্য দখলে নিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন তাঁরাও। অন্যদিকে চাঁদা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে রাজি নয় আসলাম পরিবার।

রাজধানীতে চাঁদাবাজির এই সাম্রাজ্য নিয়ে মুখোমুখি তিন গ্রুপ হচ্ছে আসলাম পরিবারের পক্ষে প্রয়াত আসলামের বড় ভাই জেপির (মঞ্জু) প্রেসিডিয়াম সদস্য মফিজুল ইসলাম বেবু, আসলামের শ্যালক ও কেরানীগঞ্জের একসময়ের যুবদল নেতা, বর্তমানে মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুনসুর এবং তাঁদের সঙ্গে আছেন আসলামুল হকের স্ত্রী।

দ্বিতীয় গ্রুপে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা সবাই এত দিন আসলামুল হকের অনুগত হিসেবে চাঁদা আদায় করে আসছিলেন। এখন তাঁরা আর এমপি পরিবারকে চাঁদার ভাগ দিতে রাজি নন। তাঁদের মধ্যে আছেন দারুসসালাম থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. ইসলাম, শাহ আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আগা খান মিন্টু, মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামসুল হক, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুজিব সরোয়ার মাসুম, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু তাহের ও তাঁর ভাই আবু রায়হান। এঁরা একসময়ের বিএনপি নেতা ডিপজলের ক্যাডার হিসেবে কাজ করতেন।

তৃতীয় গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য নাবিল খান। তিনি ক্রসফায়ারে নিহত পিয়ালের ভাই, যিনি কাউন্দিয়া এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, আসলামুলের মৃত্যুর পর নাবিল খান তাঁর লাইসেন্স করা দুটি শটগান এবং বেতনভুক্ত দুজন বডিগার্ড নিয়ে চাঁদাবাজির সবচেয়ে বড় খনি বলে পরিচিত কাঁচামালের আড়তে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেন।

চাঁদাবাজির ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে শাহ আলী মাজারের সামনে ও পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধ ঘেঁষে গড়ে তোলা ঢাকার সবেচেয়ে বড় কাঁচামালের আড়ত, বুড়িগঙ্গা তীরের কয়লাঘাট, পাথরঘাট, সিমেন্টঘাট ও সারঘাট; শাহ আলী মাজারের বিপণিবিতান, বেসরকারি স্কুল-কলেজ, একাধিক বাসস্ট্যান্ড, একাধিক টেম্পোস্ট্যান্ড ও ফুটপাতের দোকান।

চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ঢাকার এই এলাকা এতই কুখ্যাত যে মিরপুর ১ নন্বর সেকশনের মুরগিবাজারের সব বিক্রেতাকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ক্রেতাদের ওজনে কম দিতে বাধ্য করার ঘটনাও জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের প্রধান ওই ওজনে কম দেওয়া বাবদ প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা চাঁদা নেন।

শাহ আলী মাজারকেন্দ্রিক গড়ে তোলা কাঁচাবাজারের জায়গাটির মালিক শাহ আলী মাজার কর্তৃপক্ষ। এখানে পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। দোকানিদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিটি দোকান বরাদ্দ দেওয়ার সময় দোকানের আয়তন ও অবস্থানভেদে অগ্রিম হিসেবে নেওয়া হয়েছে দুই থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে গড়ে নেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। মোট নেওয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। মাজার কমিটির সভাপতি হিসেবে ওই টাকা নিয়েছেন আসলামুল হক। আড়তে যেসব বিক্রেতা মাল নিয়ে আসেন, তাঁদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয় আবার আড়তদারদের কাছ থেকেও চাঁদা নেওয়া হয়। দোকানভেদে চাঁদার পরিমাণ গড়ে এক হাজার টাকা। সে হিসাবে এই একটি খাত থেকে চাঁদা ওঠে দিনে ৫০ লাখ টাকা। কয়লাঘাট, পাথরঘাট, সারঘাট ও সিমেন্টঘাটের প্রতিটি থেকে গড়ে দিনে ২০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, গড়ে প্রতিটি ঘাট থেকে ২৫ লাখ টাকা করে চাঁদা আসে। চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে মিরপুর-২ নম্বর, ১ নম্বর, মাজার রোড, গাবতলীর সব লোকাল বাস ও এলাকার টেম্পো থেকে প্রতিদিন কম করে হলেও ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। ঢাকা-১৪ আসন এলাকার ফুটপাতে প্রায় ১৫ হাজার দোকান বসানো হয়েছে। প্রতিদিন দোকান থেকে দিনে গড়ে ৫০০ টাকা করে চাঁদ নেওয়া হয়। আবার দোকান বসানোর সময়ও অগ্রিম নেওয়া হয়। ১৫ হাজার দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আসলামুল হকের অনুগত হিসেবে এই চাঁদা তোলার দায়িত্ব পালন করতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ইসলাম, মুজিব সরোয়ার মাসুম, আগা খান মিন্টু, শামসুল হক, আবু তাহের এবং তাঁর ভাই রায়হান, আসলামুলের শ্যালক মুনসুর ও তাঁর ভাই মফিজুল ইসলাম বেবু। এ ছাড়া বিভিন্ন বিপণিবিতান, স্কুল-কলেজ থেকে মাসিক ভিত্তিতে সংসদ সদস্য ও তাঁর পরিবার এবং তাঁর অনুগত লোকেরা নিয়মিত বিপুল অর্থ আদায় করতেন। আসলামের নিয়ন্ত্রিত ঠিকাদারি নিয়েও বিরোধ শুরু হয়েছে। ১২ বছর ধরে আসলামুলের হয়ে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন মুজিব সরোয়ার মাসুম, এজাজ আহমেদ স্বপন, তোফাজ্জল হোসেন টেনু ও আসলামের শ্যালক মুনসুর।

সংসদ সদস্যের পরিবারের হয়ে ১২ বছর ধরে চাঁদাবাজির অর্থ সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হোতা হিসেবে আলোচনায় থাকা আসলামুল হকের ভাই মফিজুল ইসলাম বেবুর কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে যার যা ইচ্ছা লিখুক, আমি কিছু বলব না। তবে অন্য কেউ এলাকার দখল নিতে পারবে না, এটা বলতে পারি।’

চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আগা খান মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি, চাঁদাবাজি করি না। চাঁদাবাজি আমার কাজ নয়।’ ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুজিব সরোয়ার মাসুম কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি সংসদ সদস্য আসলামুল হকের সঙ্গে ছিলাম; কিন্তু এর মানে এই নয় যে চাঁদাবাজি করেছি।’ কারা করেছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা জানি না।’ তাহলে কি চাঁদাবাজি হয়নি বা হচ্ছে না—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনারা খুঁজে দেখুন।’ নতুন করে চাঁদাবাজির দখল নিতে চাওয়া নাবিল খান সব কিছু অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি ওই সবের মধ্যে নেই।’

তবে এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে দারুসসালাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাযহারুল হক বলেন, ‘সংসদ সদস্য জীবিত থাকতেও চাঁদাবাজি হয়েছে, তাঁর পরিবারের লোকসহ তাঁর অনুগত কিছু রাজনৈতিক লোক জড়িত ছিল, তারা এখনো করছে। আবার শুনছি এখন এমপির একসময়ের অনুগতরা এবং আরো কিছু লোক চাঁদাবাজির একক নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। এটা দ্রুত না ঠেকালে এলাকায় মার্ডার হবে। তবে আমি ওই সবের মধ্যে নেই।’-কালের কণ্ঠ