খুলনা-মংলা রেললাইন

পাঁচবার সময় বৃদ্ধি করে এক যুগেও হয়নি ৬৫ কিমি লাইন

পাঁচবার সময় বৃদ্ধি করে এক যুগেও হয়নি ৬৫ কিমি লাইন

জবাবদিহিতা নেই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ ও ব্যয় বৃদ্ধিতে। বছরের পর বছর চলমান রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো। পরিকল্পনা কমিশনের কাছে সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। কমিশন সুপারিশ করায় একনেক সেটাকে অনুমোদন দিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ ৩ বছরের কাজ। অনুমোদন নিয়ে ছয় বছর কোনো কাজ হয়নি। গত ১০ বছরেও এই লাইন নির্মাণ করতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে। পাঁচ বা সাত বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। এক হাজার ৭২১ কোটি টাকার খরচ এখন প্রায় তিনগুণ বেড়ে চার হাজার ৩২৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট-১ এবং ৩ এই দু’টির আওতায় নেয়া ঋণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। আবারো সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রকল্প পরিচালক মো: আরিফুজ্জামান বলেন, এখন তো করোনা পরিস্থিতি যাতে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাদের ঠিকাদার হলো ইন্ডিয়ান। মালামাল আসে ইন্ডিয়া থেকে। ইন্ডিয়ার অবস্থা এখন সবচেয়ে শোচনীয়। আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে এতে কোনো সংশয় নেই। তবে কাজ আমরা বন্ধ রাখিনি।

আইএমইডি ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একনেকে এক হাজার ৭২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন বছরে সমাপ্ত করার জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু লাফিয়ে প্রকল্পের সময় বাড়ছে, বাড়ছে ব্যয়ও। অনুমোদনের ছয় বছর পর প্রকল্পের ডিজাইনসহ বিভিন্ন অঙ্গে পরিবর্তন আনা হয়। প্রাথমিকপর্যায়ে এলাইনমেন্ট চূড়ান্তকরণে দেরি হওয়ায় ফাইনাল সার্ভে, এলএ প্লান এবং ডিটেইল ডিজাইন করতে দেরি হয়। অ্যাপ্রোচ রোড ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক সর্বশেষ ভূমি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। এরপর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন, এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর এবং তারপর ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তবে কাজ হয়েছে ৬৩ শতাংশ। অথচ এই সময়ে ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ করার কথা ছিল। আর অর্থ খরচ হয়েছে ৬৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আইএমইডির প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন করে ব্যয় ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা হওয়ায়, সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৪৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণের দুই হাজার ৩৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আবারো সময়ে বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩২৯ কোটি ১০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবনা থেকে জানা যায়, প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো হলো- ভূমি অধিগ্রহণ, খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ, ২১ দশমিক ১১ কিলোামিটার লুপ লাইন নির্মাণ, রেলওয়ে স্টেশন আটটি, ৩১টি মেজর ও মাইনর ব্রিজ, ১১২টি কালভার্ট, রূপসা নদীর উপর ৭১৬.৮০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ এবং রূপসা সেতুর দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট নির্মাণ।

প্রাক্কলিত ব্যয় ও সময় বাড়ছেই
রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে ২০১০ সালে ১২ জানুয়ারি একটি যৌথ বিবৃতি ইস্যু করা হয়। এ ছাড়া সার্ক মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট স্টাডি থেকে মংলা পোটের মাধ্যমে নেপাল, ভুটান মালামাল আমদানি বা রফতানি করতে পারে বলে প্রস্তাব করা হয়। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা-মংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণসহ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে, একটি প্রকল্প এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায়। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা। প্রকল্পটি ভারত সরকারের (এলওসি) ঋণের অর্থে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অনুমোদিত ব্যয়ের মধ্যে ভারতীয় ঋণ এক হাজার ২০২ কোটি ৩১ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ৫১৯ কোটি টাকা। এরপর ব্যয় ১২০ দশমিক ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে তিন হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি নেই।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য
রেলওয়ের প্রস্তাবনার তথ্য অনুযায়ী প্রকল্প নেয়ার উদ্দেশ্য হলো, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ অঞ্চলকে ঢাকার সাথে সরাসরি সংযোগ করার জন্য পদ্মা নদীর উপর একটি বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ চলমান আছে। এই সেতুতে ব্রডগেজ রেলওয়ের সুবিধা বিদ্যমান। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জাতীয় যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এতে প্রথমপর্যায়ে পদ্মা রেলওয়ে সংযোগ ভাঙ্গা পর্যন্ত হবে। দ্বিতীয়পর্যায়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ বর্ধিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য মংলা বন্দরকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করা প্রয়োজন। এতে খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান এই রেলপথের মাধ্যমে মংলা বন্দর ব্যবহার করে তাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য করতে পারবে। বতর্মানে ফুলতলা স্টেশন থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ বিদ্যমান।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাঠপর্যায়ের কাজ আরম্ভ করা হয়। কাজ আরম্ভ করতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির গুণাগুণ আশানুরূপ নয়। ফলে নতুনভাবে ডিজাইন রিভিউ করে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে গ্রাউন্ডিংসহ পাইলিং কাজ করতে হয়েছে। এতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হয়। বিষয়টি ইআরডি ও ভারতীয় হাইকমিশনকে অবহিত করা হয়েছে। কোভিডের কারণে কাজ বিভিন্ন সময় স্থগিত থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা প্রয়োজন। এখনো ট্র্যাক নির্মাণকাজের চুক্তিপত্রের বিপরীতে দাখিলকৃত প্রথম ভেরিয়েশন প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি। ফলে কাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।

আইএমইডি ও প্রকল্প পরিচালক জানান, খুলনা-মংলা রেললাইনের দ্বিতীয় প্যাকেজের জন্য জলপাইগুড়ি থেকে আনা স্লিপার ব্যবহার অযোগ্য বলে প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। মানহীন পণ্য ব্যবহার করা হবে না বলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সাফ জানিয়ে দিয়েছে। ফলে এ রেললাইনের কাজ শেষ হতে আরো একটু দেরি হতে পারে।

প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার ব্যাপারে আইএমইডি বলছে, জমি অধিগ্রহণে দেরি, কাজের মাঝামাঝি এসে পরামর্শক পরিবর্তন করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘সিইজি-নিপ্পন কই জেভি’ থেকে স্টপ কনসালট্যান্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু কিছু জটিল নন-টেন্ডার আইটেম আসায়, যেমন অত্যধিক লুজ সয়েল থাকায় ট্রিটমেন্ট, পাইল বারবার ফেল করায় ও বেস গ্রাউন্ডিং, এতে অধিক সংখ্যক আনাড়ি সাবকন্ট্রাক্টর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পের কাজ বারবার পিছিয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, আগে থেকে মাটি পরীক্ষা করে প্রকল্পের এলাকা নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী ডিজাইন প্রণয়ন করা হলে প্রকল্পে এতটা সময়ক্ষেপণ হতো না। পাশাপাশি ঋণদাতার কাছেও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতো না।

প্রকল্প পরিচালক মো: আরিফুজ্জামানের সাথে গতকাল মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ ৭৬ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে। আশা করছি যে কাজ বাকি আছে তা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। তবে বতর্মানে করোনা পরিস্থিতির যে অবস্থা বিরাজ করছে তার উপর নির্ভর করছে মাঠপর্যায়ের এই কাজ সম্পন্ন করা। তিনি বলেন, করোনার মাঝেও আমরা স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজ চলমান রেখেছি। তবে দেড় বছর বৃদ্ধির প্রস্তাবনায় অন্যান্য ইস্যু আছে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি যখন অনুমোদন হবে তখন জানতে পারবেন। এখন আমাদের ইন হাউজ ওয়ার্ক হচ্ছে। আমাদের প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনে যাবে, সেখানে যাচাই-বাছাই হয়ে চূড়ান্ত হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, বড় ব্যয়ের প্রকল্পগুলো নেয়ার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি ভালোভাবে করা উচিত। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের বিষয় থাকলে সেগুলোকে আগে সমাধান করা দরকার। ডিজাউন ও নকশাগুলো ভালোভাবে করা দরকার। তারপর মূল প্রকল্প প্রস্তাব করা উচিত। তিনি বলেন, এই প্রকল্পটি নেয়ার আগে অবশ্যই মাটি পরীক্ষা ঠিকমতো করা উচিত ছিল। বিদেশী ঋণের প্রকল্প সময়মতো শুরু ও শেষ করতে না পারলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। এখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তদারকির গাফিলতি আছে বলেই এতটা সময় লাগছে। সূত্র : নয়া দিগন্ত

এমজে/