ঈদ উদযাপন যেন করোনা বৃদ্ধির উপলক্ষ না হয়: হাসিনা

ঈদ উদযাপন যেন করোনা বৃদ্ধির উপলক্ষ না হয়: হাসিনা

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে করোনার ভয়াবহতার বিষয়ে আবারও সতর্ক করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উদযাপনের অনুরোধ জানিয়েছেন। এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ঈদ উদযাপন করবো, তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে। কোনোভাবেই এই ঈদ উদযাপন যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির উপলক্ষ হয়ে না ওঠে, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

বৃহস্পতিবার (১৩ মে) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় শুরু হওয়া এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সম্প্রচার করে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাষণ সম্প্রচারিত হয়।

দেশবাসীকে উদ্দেশ করে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ নামক এক প্রাণঘাতী ব্যাধি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই ভাইরাস একদিকে যেমন অগণিত মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিসাধন করছে মানুষের জীবন-জীবিকার। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই ভাইরাস।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রসঙ্গে সরকার প্রধান বলেন, গত বছরের শেষদিকে যখন বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ অনেকটা কমতে শুরু করেছিল, তখন সকলের সঙ্গে আমরাও আশান্বিত হয়েছিলাম যে বিশ্ববাসী বুঝি এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি থেকে দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের সকল পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা নস্যাৎ করে দেয়।

তিনি বলেন, মানুষের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। কাজেই জনসমাগম এড়াতে না পারলে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। এ কারণে কষ্ট হবে জেনেও আমরা বাধ্য হয়েছি মানুষের স্বাভাবিক চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে। দোকানপাট, শপিং মলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখতে হচ্ছে। একই কারণে গণপরিবহন চলাচলের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

বেঁচে থাকলে আমরা আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ করতে পারবো

করোনার ভয়াবহতার বিষয়ে আবারও সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী যে যেখানে আছেন সেখানে থেকেই ঈদের আনন্দ উপভোগ করার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আপনারা আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে যাবেন না। অনেকের কোনও বাহ্যিক লক্ষণ না থাকায় বুঝতে পারবেন না আপনার পাশের ব্যক্তিটিই করোনাভাইরাস বহন করছে। এর ফলে আপনি যেমন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে পড়বেন, তেমনি আপনার নিকটাত্মীয় বা পাড়া প্রতিবেশীকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন। মনে রাখবেন, সবার ওপরে মানুষের জীবন। বেঁচে থাকলে আসছে বছর আবার আমরা আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে পারবো।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মসজিদে ঈদের জামাত

ঈদের জামাত মসজিদে অনুষ্ঠানে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে গত বছরের মতো এ বছরও ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মসজিদে মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে।

দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিত্তবান ও সামর্থ্যবানদের এ দুঃসময়ে দরিদ্র প্রতিবেশী, গ্রামবাসী বা এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আপনার সাহায্য হয়তো একটি পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে। দেখবেন, তাদের হাসিমুখ আপনার হৃদয় ও মনকে পরিপূর্ণ করে তুলবে ঈদের আনন্দে। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় কর্তব্য। আমরা যেন এই কর্তব্যকর্ম ভুলে না যাই।

তিনি বলেন, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ কয়েকটি পেশার কর্মীগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে থেকে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা লকডাউন বা চলাচলের বিধিনিষেধ বলবৎ করতে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণসহ সরকারের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। সংবাদকর্মীরা সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে সংবাদ পরিবেশনের কাজ করে যাচ্ছেন। সবাইকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

করোনা সংক্রমণে মৃত্যুবরণকারীদের স্মরণ করে সরকার প্রধান বলেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বহু স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা আমাদের অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি। আমি সকলের রুহের মাগফিরাত ও আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

১৩০টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছি। আক্রান্তদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছি। চিকিৎসা সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি করেছি। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাসপাতালকেও করোনাভাইরাস চিকিৎসায় সম্পৃক্ত করেছি। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ১৬৬ জন ডাক্তার, ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স এবং প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জেলা হাসপাতালগুলোসহ দেশের ১৩০টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

মাস্ক পরুন, দূরত্ব বজায় রাখুন

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। পাশাপাশি যথাসম্ভব ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। গরম পানির ভাপ নিতে পারেন।

কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে লকডাউন দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে না, বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সংক্রমণ এড়াতে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি বলবৎ করতে হয়েছে। আমরা গত বছর একটানা দুই মাসেরও বেশি সাধারণ ছুটি বলবৎ করেছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর গত মাসের ৫ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে অগণিত মানুষের রুটি-রুজির ওপর আঘাত এসেছে। কিন্তু এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কোনও উপায় ছিল না।

কোনোভাবেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে দেওয়া যাবে না

সরকারের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রতিটি দেশেরই স্বাস্থ্য অবকাঠামোর একটি নির্দিষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। হঠাৎ দ্রুতগতিতে রোগী বাড়তে থাকলে তখন সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত করোনা রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেজন্য আমাদের কোনোভাবেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে দেওয়া যাবে না।