বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ভারতের পতিতালয়ে টিকটক হৃদয়ের নারী বিক্রি

বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ভারতের পতিতালয়ে টিকটক হৃদয়ের নারী বিক্রি

ভারতে গণধর্ষণের শিকার নারীকে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার করে একটি পতিতালয় বিক্রি করেছিল মগবাজারের রিফাজুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২৬)। এর আগে এই নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে টিকটক হৃদয়। ভিকটিম নারীকে শনাক্ত করে একটি পতিতালয় থেকে তাকে উদ্ধার করে ভারতের বেঙ্গালুরুর পুলিশ। এরপর একেএকে অভিযুক্ত চার তরুণ ও দুই নারীকে গ্রেফতার করে তারা। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশকেও গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বেঙ্গালুরুর পুলিশ।

গ্রেফতারকৃত টিকটক হৃদয়কে দ্রুত দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়াও শুরু করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এই ঘটনায় দু’দেশেই মামলা ও তদন্ত চলবে বলেও জানিয়েছেন।

যেভাবে ভারতে পাচার হয় কিশোরগঞ্জের দরিদ্র নারীকে
ভারতে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর থানা এলাকায় (ভিকটিমের নিরাপত্তার স্বার্থ নাম পরিচয় গোপন রাখা হলো)। দরিদ্র পরিবারে জন্ম বলে মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনি পড়ালেখা করতে পেরেছেন। ২০১৪ সালে প্রেম করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের কুয়েত প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে ওই নারী কে শ্বশুরবাড়ীর কেউ মেনে নেয়নি। তাকে বিভিন্ন সময় শ্বশুরবাড়ীর নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করতে হতো। যে কারণে তিনি বিয়ের প্রায় ৫ বছর পর পর্যন্ত বাবার বাড়ি কিশোরঞ্জে থাকতেন। স্বামীও কোনও খোঁজ খবর নিত না। বাবার আর্থিক অনাটনের কথা চিন্তা করে নারী সৌদি আরব যাওয়ার চিন্তা করেন। ঢাকায় কয়েক মাস হাতিঝিল এলাকায় ছিল। ঢাকায় থাকা অবস্থায় সৌদি যাবার জন্য একবার এক দালালকে ত্রিশ হাজার টাকাও দেন ওই নারী ও তার বাবা। তবে দালাল তাদের টাকা আত্মসাৎ করে। এরপর নারী কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যান কয়েকমাস আগে। তার ৪ বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। সে বর্তমানে চাঁদপুরে তার দাদা দাদির কাছে রয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে ওই নারীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়, হৃদয় তাকে ভালো বেতনে চাকরিসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করে। এরপর সেখানে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় তাকে।

কে এই টিকটক হৃদয়?
মগবাজার ও হাতিরঝিল এলাকায় টিকটক হৃদয়কে সবাই বখাটে হিসেবে চিনে। সে গ্রুপ নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় টিকটক করে বেড়াতো। তার পুরো নাম মো. রিফাজুল ইসলাম হৃদয় (২৬)। বাবা মো. আবুল হোসেন। হাতিরঝিলে নয়াটোলা(বৌ-বাজার) এলাকায় বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকতো। সে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। হৃদয় বাবু কোনও কাজ করতো না সারাদিন বন্ধুদের নিয়ে টিকটক ভিডিও তৈরি করতো। কোনও কাজ না করার কারণে তার মা তাকে চার মাস পূর্বে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কিছুদিন পরেই হৃদয় ইন্ডিয়া চলে যায়। বর্তমানে সে ইন্ডিয়ার পুনেতে অবস্থান করছে। দেশে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে রমনা থানায় ডাকাতি প্রস্তুতি মামলা হয়েছিল।

হৃদয়ের চাচা বাবুল মিয়া জানান, হৃদয়ের অনেকদিন ধরে খোঁজ পাচ্ছিল না তারা। পরবর্তীতে জানতে পারে সে ইন্ডিয়াতে রয়েছে। বখাটে হওয়াতে তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়।

যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর হৃদয়ের খোঁজে পুলিশ তাদের বাসায় যায়। এরপর হৃদয়কে তারা ভিডিও দেখে শনাক্ত করে।

বুধবার রাতে হাতিরঝিল থানা পুলিশ হৃদয়ের বাসায় গিয়ে তল্লাশি চালায়। তখন তার জেএসসির এডমিট কার্ড, রেজিস্টেশন কার্ড ও একটি জাতীয় পরিচয় পত্র জব্দ করে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার বাবা মা, মামা ও চাচাদের। রাতে তাদের অনেককেই থানায় নিয়ে আসা হয়। মামা ফরহাদ হোসেনের মোবাইল দিয়ে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পুলিশ হোয়াটসঅ্যাপে ছদ্মবেশে বুধবার রাতে যোগাযোগ করে। পুলিশ তাকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, হৃদয় জানায় ঘটনাটি ১৫/১৬ দিন আগের। তারা ভারতের পুনেতে রয়েছে। এরপর বাংলাদেশের পুলিশ ভারতের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ভারতের পুলিশ অভিযান শুরু করে। বৃহস্পতিবার হৃদয়সহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ভারতের বেঙ্গালুরুর পুলিশ।

টিকটক তার ফাঁদ
টিকটক ব্যবহারের কারণে তার নামই হয়ে যায় টিকটক হৃদয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। মগবাজারের কিশোর সুমন জানান, হৃদয় খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের নিয়ে হাতিরঝিলে টিকটক বানাতো।

ভারতের বেঙ্গালুরুর এক তরুণী আত্মহত্যা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভিডিও ছড়িয়ে পরে। অনেকেই অভিযোগ করেন, ভিডিওতে যে নারীকে দেখা যায় তিনিই আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ পরবর্তীতে তদন্ত শুরু করে নিশ্চিত হয়। যে তরুণী আত্মহত্যা করেছে তিনি ভিডিওতে থাকা নির্যাতনের শিকার নারী না। ভিডিওতে থাকা নারী বাংলাদেশি। বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার কামাল পন্ত বৃহস্পতিবার যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতারের পর একটি টুইট করেন। তিনি টুইটে লেখেন, ‘ভিডিওতে দেখা যৌন নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার নারীকে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। টাকা পয়সার লেনদেন কেন্দ্রিক ঘটনায় নিষ্ঠুরভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।’

ভারতে হৃদয়সহ গ্রেফতার ৬
বাংলাদেশি নারীতে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় ২ নারীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে বেঙ্গালুরুর পুলিশ। এদের মধ্যে দুই নারীর নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। গ্রেফতারকৃত চার তরুণ হলো- মোহাম্মদ বাবা শেখ, রিদা বাবু, সাগর ও আখিল। হৃদয় বাবু ভারতে তার নাম আংশিক পরিবর্তন করে হৃদা বাবু করেছে।

হাতিরঝিল থানায় ভিকটিম নারীর বাবার মামলা
হাতিরঝিল থানায় ভিকটিম নারীর বাবা বাদি হয়ে, হৃদয়সহ অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা করেছেন। মামলাটি পুলিশ তদন্ত শুরু করেছেন।

ঢাকার পুলিশের বক্তব্য
ডিএমপি'র তেজগাঁও জোনের উপপুলিশ কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, টিকটক হৃদয়ের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। তাকে ভারতের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সেখানেও একটি মামলা হয়েছে। ঢাকায় ভিকটিমের বাবা একটি মামলা করেছে। আমরা আমরা সেই মামলাটিও তদন্ত শুরু করেছি। ইতিমধ্যে টিকটক হৃদয়ের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। তাকে যত দ্রুত সম্ভব ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।