টিবি হাসপাতালে দুর্নীতি

২৩,০০০ টাকার আলমারি ৯৬,০০০ টাকা

২৩,০০০ টাকার আলমারি ৯৬,০০০ টাকা

স্টিলের একটি আলমারির মূল্য ২৩ হাজার টাকার মধ্যে হলেও তা ৯৬ হাজার টাকা দরে কিনেছে রাজধানীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একশোটি আলমারি কেনাকাটায় অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে।

কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালে হাসপাতালের জন্য বাজারের চেয়ে বেশি দামে ১৯টি মেডিকেল যন্ত্রপাতিও কিনেছে।

গতকাল দুদকের বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, হাসপাতালের সাবেক এবং বর্তমান উপ-পরিচালক সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রায় ৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকার সরকারি অর্থের অপব্যবহার করছে বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

দুদকের সহকারী উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মেরাজ গতকাল হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবু রায়হান, সাবেক উপ-পরিচালক ইমরান আলী, নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আফসানা ইসলাম, প্রমিক্সকো লিমিটেডের চেয়ারম্যান মৌসুমী ইসলাম এবং আহমেদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মুন্সী ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছেন।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০১৭ সালে ১৫০ শয্যার ইনডোর সার্ভিস, আউটডোর সার্ভিস, ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা এবং অপারেশন থিয়েটারসহ হাসপাতালটির উদ্বোধন করেছিলেন।

দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘অর্থ বরাদ্দের আগেই হাসপাতালের সাবেক উপ-পরিচালক ইমরান আলী সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে পণ্যের বাড় বাড়িয়ে দেন। পরে তিনি দরপত্র আহ্বান করে অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ পাইয়ে দেন।’

নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ আট লাখ টাকায় একটি ডায়াথারমি মেশিন এবং একটি স্পিরোমিটার ৫৪ লাখ টাকায় সরবরাহ করে। তবে তদন্তে দুদক প্রমাণ পেয়েছে যে, একটি ডায়াথারমি মেশিনের দাম ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং একটি স্পিরোমিটারের দাম ৩ লাখ টাকা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রমিক্সকো থেকে ছয় ধরনের বেশকিছু যন্ত্র কিনেছে।

দুদক সূত্র জানায়, ‘প্রমিক্সকো ৫৬ হাজার ৪১২ টাকার একটি সিরিঞ্জ পাম্পের জন্য ২ লাখ ৭ হাজার টাকা এবং ৭৩ হাজার ৪০ টাকার ইসিজি মেশিনের জন্য ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা নিয়েছে।’

প্রমিক্সকো আটটি ইসিজি মেশিন সরবরাহ করেছে।

তদন্তে দেখা গেছে, প্রকৃত মূল্য ৮৮ হাজার ৯১৭ টাকা হলেও প্রমিক্সকোর সরবরাহ করা ১০টি ইনফিউশন পাম্পের প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে, দুই লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

ব্রোঙ্কোস্কোপ যন্ত্রের মূল্য ২০ লাখ ২৪ হাজার টাকা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এটি কিনেছে ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়।

হাসপাতালটি ১১ হাজার ৮০০ টাকা দরে ২০ টি ভোল্ট-স্ট্যাবিলাইজার কিনেছে যেখানে প্রতিটির প্রকৃত মূল্য ৩,৯২৪ টাকা।

আলমারিগুলোও সরবরাহ করেছে প্রমিক্সকো।

তৃতীয় ঠিকাদার আহমেদ এন্টারপ্রাইজ হাসপাতালে একটি ডিফিব্রিলেটর, একটি ভিডিও ল্যারিঙ্গোস্কোপ, অস্ত্রোপচারের জন্য একটি হেডলাইট, পাঁচটি পালস অক্সিমিটার, অটোক্লেভ মেশিন, ১০টি রোগীর শয্যা (ট্রাইফাংশনাল), পাঁচটি হাই-ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা, পাঁচটি সিরিঞ্জ পাম্প, একটি সিপিআর মিটার, একটি অক্সিজেন অ্যানালাইজার, চারটি পেশেন্ট মনিটর এবং পাঁচটি আইসিইউ ভেন্টিলেটর সরবরাহ করেছে।

দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, সরবরাহকৃত পণ্যের প্রকৃত দাম ছিল ১৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্তি পরিশোধ করেছে। মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

ঘুরেফিরে পুরনো অভিযুক্তরা

অভিযুক্ত তিন ঠিকাদারের মধ্যে দুজন ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণে সরকারি অর্থের অপব্যবহারের কারণে দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি হয়েছেন।

গত বছরের ১৬ আগস্ট হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের জন্য বই ও জার্নাল কেনার দরপত্র নিয়ে কারচুপির মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা অপব্যবহারের জন্য নির্ঝরা স্বত্বাধিকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজিএইচএস) আহমেদ এন্টারপ্রাইজকে গত বছরের জুনে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।

এর মালিক ফারুকের ভাই মুন্সী সাজ্জাদ হোসেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। হাসপাতালের কর্মকর্তা হয়ে সাজ্জাদ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন। তিনিও কালো তালিকাভুক্ত অনিক ট্রেডার্সের মালিক।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে প্রায় ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারুক, সাজ্জাদ ও তাদের ভাই আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের নভেম্বরে মামলা করেছে দুদক।

দ্য ডেইলি স্টার চেষ্টা করেও তাদের কোনো বক্তব্য সংগ্রহ করতে পারেনি।

প্রমিক্সিকোর চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সচিব কামাল শাহরিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গতকাল তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি চেয়ারপারসনের সঙ্গে কথা বলে তাদের বক্তব্য ডেইলি স্টারকে জানাবেন।

তবে তারপর থেকে তারা আর কোনো যোগাযোগ করেনি।

টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক রায়হান জানিয়েছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় তিনি জড়িত নন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ২০১৮ সালের মার্চে যোগদান করি, তখন দরপত্র প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

ইমরান আলীর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।-ডেইলি স্টার