অনিশ্চয়তার মধ্যেও জমে উঠেছে চাঁপাইয়ের আমের বাজার

অনিশ্চয়তার মধ্যেও জমে উঠেছে চাঁপাইয়ের আমের বাজার

অবশেষে আলোর মুখ দেখল আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম মৌসুম। জাতীয় এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশেষ লকডাউন মিলিয়ে আম মৌসুমের শুরু থেকেই চলছিল এক অনিশ্চয়তা। দেশের সর্ববৃহৎ কানসাটের আমের বাজারসহ জেলার সব ক’টি আমের বাজারে অবিশ্বাস্যভাবে অচলাবস্থা বিরাজ করেছে। বিশেষ লকডাউন গতকাল মঙ্গলবার থেকে শিথিল হওয়ার পর সচল হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ভুবন। তবে ভীতি আর অনিশ্চয়তা যেন এখনো নিত্যসঙ্গী।

জেলায় আনুষ্ঠানিক আম পাড়া শুরু হয় ২১ মে থেকে। কিন্তু এ সময় লকডাউনের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল পুরোটাই বিচ্ছিন্ন। পরবর্তী সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫ মে থেকে বিশেষ লকডাউন শুরু হলে আম মৌসুমের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। অবশ্য স্থানীয়ভাবে কুরিয়ার সার্ভিস চালু থাকায় জেলা থেকে পরিমাণে অল্প হলেও আম পরিবহন হতে থাকে। এ সময় আমের ব্যবসা অনেকটাই চলে যায় হালের অনলাইন ব্যবসায়ীদের হাতে। স্থানীয় তরুণরা বিশেষত কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুবাদে বাসাবাড়িতে অলস দিন কাটাচ্ছিল তারা হাল ধরে আম ব্যবসার। রাতারাতি এরাই হয়ে ওঠে জেলার সবচেয়ে বড় আম ব্যবসায়ী। এই মুহূর্তে ফেসবুক পেজ, অনলাইন পোর্টালসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের প্রচার-প্রচারণায় আমবাজার প্রাণ পেয়েছে।

বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটির ছাত্র জুবের আক্রাম নিলয় রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়–য়া বন্ধুকে সাথে নিয়ে আনলাইনে আম পাঠাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। গত বছর যখন দেশে লকডাউন চালু ছিল তখনো ঠিক এ রকম বিপাকে পড়েছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম। ঠিক তখনই নিলয়ের মাথায় আসে অনলাইনে আম বাজারজাত কার। গত বছরের শুরুটা খুব ফলপ্রসূ না হলেও এবার নিলয়ের অনলাইন জগতে বেশ সাড়া। ইতোমধ্যে শতাধিক মণ আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী নিলয় জানালো তারা আরো অন্তত ২০০ জন ছাত্রছাত্রী অনলাইনে আমের ব্যবসায়ে যুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শিবগঞ্জের হাফিজুর রহমান, শাহীবাগের শাহীনুর, রাজারামপুরের আ: ওয়াহিদ ও আয়েশা সিদ্দিকা মওসুমি, বাতেন খাঁ মোড়ের প্রিন্স, বালুবাগানের বাবুর নাম তার মুখ থেকেই উঠে আসে।

অনলাইনের বাইরে আমবাজারের তরুণ ও উদ্যমী ব্যবসায়ী মামুন বিভিন্ন মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে আমের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় ৩০০ মণ আম দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেছেন। অবশ্য এর বড় অংশটাই গেছে সেনাবাহিনীর বহরে। সেনা সংস্থার নিজস্ব পরিবহনের কারণেই তা প্রেরণ সম্ভব হয়েছে। তার মতো আমবাজারের সফল ব্যবসায়ীরা যে যার মতো করে বিভিন্ন মাধ্যমে আম প্রেরণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেনÑ আহমদ, একাবুদ্দিন, সাজুলালের মতো ব্যবসায়ীদের নাম। গত সোমবার হিমসাগর তথা খিরসাপাত বিক্রি হয়েছে ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা মণ দরে। তেমনিভাবে বোম্বাই খিরসা ১৪০০ থেকে ১৬০০, খুদি খিরসা হাজার থেকে ১২০০, গোপালভোগ ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এখনো ল্যাংড়া বাজারজাত শুরু হয়নি। জেলার বাইরের আম ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ লকডাউনের কারণে আসতে না পারায় বাজারের তেজিভাব নেই। দেখা দেয়নি উৎসবমুখর আমের বাজার। অবশ্য এখনো লকডাউন, বিধিনিষেধ আর করোনাভীতি থেকে সার্বিক আম মৌসুমের কী অবস্থা দাঁড়ায় তা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা।

ম্যাংগো প্রোডিউসার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাবেক চেম্বার সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ জানান, লকডাউন প্রত্যাহার হলেও বিধিনিষেধের আওতায় এবং করোনাভীতি থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকার ও আম ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসবেন কি না সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। তিনি জানান, বর্তমানে এ সময় খিরসা আমের মূল্য থাকার কথা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ। তার মতে, এ বছর প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার পৌনে তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। চার-পাঁচ লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে এতে জড়িত। অথচ এ মুহূর্তে ৮০ ভাগ লোকই বেকার হিসেবে দিন পার করছে। জেলায় বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা মাথায় নিয়ে তিনি আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের সরকারি আর্থিক প্রণোদনার আবেদন জানান।

এ দিকে আম ব্যবসায় হতাশার বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন কানসাট এলাকার শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি ইসমাইল খান। তিনি জানান, কানসাটে পুরোদমে আমবাজার শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক আম পরিবহন হচ্ছে। লকডাউন খুলে যাওয়ায় সামনের সপ্তাহেই এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তবে এ বাজারটিকে তিনি অনলাইন অর্ডার বাজার হিসেবে অভিহিত করেন। তার কথায়, জেলার ৪০ শতাংশ আমের বাজার অনলাইন ব্যবসায়ীদের হাতে। জেনারেল বাজার এখনো শোচনীয় অবস্থায়। কানসাটের ৫০০ আড়তেই কেনাবেচা চলছে। কানসাটের বাইরেও গ্রাম এলাকায় বিভিন্ন আড়তে আম কেনাবেচা হচ্ছে। তিনি জানান, আমের অনলাইন মার্কেটিং নিয়ে তিনি জাতীয় একটি প্লাটফর্ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রায় ৬০০ জন তরুণকে অনলাইন বাজার বিষয়ে হাতে-কলমে কাজ শেখাচ্ছেন।

এমজে/