মামলা নিতে পুলিশের অনীহা

ফেসবুকে ঘটনা ভাইরাল হলে তারা তৎপর হয়

ফেসবুকে ঘটনা ভাইরাল হলে তারা তৎপর হয়

বাংলাদেশে কোন অপরাধের ঘটনা নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোরগোল সৃষ্টি হয় তখন পুলিশ তৎপর হয়ে উঠে। অনেক সময় দেখা যায়, ভিকটিম থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলেও পুলিশ মামলা নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

কিন্তু বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তখন পুলিশও তৎপর হয়। থানায় মামলা গ্রহণ করা কিংবা না করার ক্ষেত্রে অভিযোগকারী কতটা ক্ষমতাবান সেটিও একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

থানা সব মামলা নেয় না

ঢাকার বাসিন্দা সেলিম রেজা পিন্টুকে প্রায় সাত বছর আগে পল্লবী এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নেয়া হয়।

সে ঘটনার পর মি. রেজার খোঁজে পুলিশের কাছে বহুবার ধর্না দিয়েছেন তার স্বজনরা। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।

নিখোঁজ স্বজনকে খুঁজে পেতে থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।

তার বোন রেহানা বানু বিবিসি বাংলার কাছে বর্ণনা দিচ্ছিলেন সেলিম রেজা পিন্টুর ভাগ্যে কী ঘটেছে সেটি পরিবারের কাছে এখনো অজানা।

রেহানা বানু বলেন, "আমরা থানায় গেলাম। তখন পুলিশ বললো এখনো ২৪ঘন্টা হয়নি, আমরা কিছু করতে পারবো না। পরের দিন আমরা আবার থানায় গেলাম। সেখানে আমাদের পাঁচ-ঘণ্টা বসিয়ে রাখলো। পরে তারা একটা জিডি নিল, কিন্তু কোন মামলা নেয়নি। আমাদের বললো আদালতে মামলা করতে।"

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ

থানায় মামলা কিংবা কোন অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ সেটি গ্রহণ করবে কি না তা নির্ভর করে পুলিশের ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছার উপর।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যক্তি বিশেষের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে পুলিশ আচরণ।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি থানায় পুলিশের উপর রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।

স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা বেশিরভাগ সময় প্রভাবিত হয় পুলিশ।

ফলে মামলা গ্রহণ করা কিংবা না করার বিষয়টিও অপরাধের ধরন বিবেচনা করে করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষক ও গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি সে কথাই বলেন। অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশের কাছে ভিকটিম কিংবা তার পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সামাজিক প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে।

কেউ অপরাধের শিকার হয়ে থানায় মামলা করতে গেলে সবাই যে একরকম আচরণ পায় না সেটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মাঝে মধ্যে স্বীকার করেন।

প্রায় দুই বছর আগে ঢাকার থানাগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছিলেন থানায় আচরণ পরিবর্তন না হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থানায় গিয়ে বসবেন।

"থানায় যারা কাজ করছে তাদের আচরণে যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে আমরা সিনিয়র অফিসাররা থানায় গিয়ে বসা শুরু করবো। আমি নিজে থানায় গিয়ে ওসিগিরি করবো," বলেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম।

পুলিশ কমিশনারের এ কথা থেকেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ থানা সম্পর্কে যেসব অভিযোগ করেন সেগুলো একেবারে অমূলক নয়।

ফেসবুকে ভাইরাল হলে গুরুত্ব বাড়ে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি হয়েছে নতুন এক প্রবণতা। বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, অভিযোগকারী প্রথমে থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়েছেন।

কিন্তু এসব ঘটনা ফেসবুকে নানাভাবে ভাইরাল হবার পরে পুলিশ বেশ তড়িত গতিতে ব্যবস্থা নিয়েছে। অতিসম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনি এর একটি উদাহরণ।

এর আগেও এ ধরনের ঘটনা বহুবার ঘটেছে। সিলেটে শিশু রাজন হত্যা, ফেনীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা, খুলনায় শিশু রাকিব হত্যাকাণ্ডসহ বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগী পরিবারকে থানা থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল মামলা গ্রহণ না করে।

পরবর্তীতে এসব ঘটনা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, একসময় সংবাদপত্রের নানা রিপোর্ট জনমত গঠন করতো এবং কখনো কখনো ভুক্তভোগীর বিচার পাবার পথ তৈরি হতো। এখন সে প্ল্যাটফর্ম বদলে গেছে।

১৯৯০এর দশকে আলোচিত রীমা হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, সে সময় রীমা হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে তৎকালীন সংবাদ মাধ্যম যদি নজর না রাখতো তাহলে অপরাধীর সাজা হতো না।

অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, "যেসব ঘটনায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য প্রচুর জনমতের প্রয়োজন হয়। রীমা হত্যা মামলার সময় সব সাংবাদিকরা যদি একজোট হয়ে জনমত গঠন না করতো, তাহলে মুনীরের বিচার ঠিকমতো হতো কি না সন্দেহ ছিল। এখন সেই প্ল্যাটফর্ম পাল্টেছে।"

পুলিশকে অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হয়

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল প্রতিদিন তাদের কাছে প্রচুর অভিযোগ আসে। কিন্তু সবগুলো মামলা আকারে নেয়া সম্ভব নয়।

অভিযোগের প্রকৃতিও গুরুত্ব বিবেচনা করে মামলা নেয়া হয় বলে পুলিশ বলছে।

পুলিশে চাকরিরত কর্মকর্তারা এ বিষয়টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে রাজি নন। সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে অগ্রাধিকার নির্ণয় করে কাজ করতে হয়।

"সোশ্যাল মিডিয়াতে ঐসব বিষয় আসে যেগুলোতে জনগণের উৎকণ্ঠা আছে। এগুলো সমাধানের জন্য যদি পুলিশ বেশি তৎপর হয়, তার মধ্যে আমি ক্ষতিকর কিছু দেখি না। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে পুলিশকে অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হয়," বলেন নুরুল হুদা।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, থানায় সহজে মামলা নথিভুক্ত না করার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।

এর মধ্যে বড় কারণ হচ্ছে, প্রতিটি থানার কর্মকর্তারা দেখাতে চান যে তাদের আওতাধীন এলাকায় অপরাধ কম হচ্ছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষক সুব্রত ব্যানার্জি বলেন, "থানায় মামলা কম নিলে সে এলাকায় অপরাধ কম হচ্ছে বলে দেখানো যায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে - পুলিশ যখন মামলা নেয় তখন সাথে সাথে তদন্ত শুরু করতে হয়। এক পর্যায়ে মামলার চার্জশিট অথবা ফাইনাল রিপোর্ট দিতে হয়। এটা কোর্টে যায়, হাজিরা দিতে হয়। এই যে একটা হ্যাসেল, এই বিষয়গুলোকে এড়ানোর জন্য পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে মামলা না নিয়ে সালিশ ব্যবস্থার মধ্যে যায়।"

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন ঘটনা নিয়ে যখন শোরগোল হয় তখন পুলিশ অনেক সময় বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারে না।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ফেসবুকে জন দাবির প্রতি নজর দিয়ে অনেক সময় প্রশংসা কুড়ানোর ঝোঁক তৈরি হয়েছে পুলিশের মধ্যে।

যেসব বিষয় নিয়ে পুলিশ মনোযোগী হতে চায় না সেগুলো নিয়ে ফেসবুকে যতই আলোচনা-সমালোচনা হোক না কেন তাতে পুলিশ কর্ণপাত করে না।

এর দুটি বড় উদাহরণ হচ্ছে- সম্প্রতি গুলশানে তরুণী মুনিয়ার কথিত আত্মহত্যা এবং কয়েকবছর আগে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তরুণী তনু হত্যাকাণ্ড।

অভিযোগ রয়েছে, মুনিয়ার কথিত আত্মহত্যার জন্য বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি অভিযুক্ত এবং তনু হত্যাকাণ্ড যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় হয়েছে - সেজন্য এগুলোর বিষয়ে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায়নি।

যেসব ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে একেবারেই আলোচনায় আসে না, সেগুলোর ক্ষেত্রে কী ঘটে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।

"সামাজিক মাধ্যমে যে শোরগোল ওঠে এর ফলে ক্ষেত্র বিশেষে প্রান্তিক মানুষ কিছু প্রতিকার পায়। তবে উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে - যখন পুলিশ প্রবল জনমতের মুখে ক্ষেত্রে বিশেষ তৎপর হয়, তখন অন্যান্য ঘটনাগুলোর যে স্বাভাবিক নজর পাওয়ায় কথা সেগুলো আর পায় না," বলেন অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমতের চাপে পুলিশ অভিযুক্তদের কখনো কখনো দ্রুত গ্রেফতার করে এবং তদন্তও দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করে। সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদা বলছেন, তদন্ত করার ক্ষেত্রে পুলিশকে অনেক সাবধানী হতে হয়। তা না হলে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যেতে পারেন।

মি. হুদা বলেন, " পুলিশকে তথ্য প্রমাণ এবং সাক্ষীর ভিত্তিতে তদন্ত করতে হয়। অন্যথায় আদালতে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না।"

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের উপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব না দূর করতে না পারলে এবং একই সাথে তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব গড়ে না উঠলে পুলিশের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ মিলবে না।