নিম্নআয়ের মানুষের দুঃসময়

নিম্নআয়ের মানুষের দুঃসময়

দেড় বছর হতে চলল, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্ব এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রতি মিনিটে বিশ্বে সাতজন মানুষ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের ছোবলে মারা যাচ্ছে, যদিও ক্ষুধা ও অনাহারে মিনিটে ১১ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।

দেড় বছর হতে চলল, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশ্ব এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রতি মিনিটে বিশ্বে সাতজন মানুষ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের ছোবলে মারা যাচ্ছে, যদিও ক্ষুধা ও অনাহারে মিনিটে ১১ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে তারচেয়ে বেশি মানুষ। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য কথিত লকডাউন অনেক দেশে সুফল দিয়েছে, অনেক দেশে দেয়নি।

বাংলাদেশেও দফায় দফায় লকডাউন বা চলাচলেরও পর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলাফল খুব স্পষ্ট নয়, বড়জোর মিশ্র। মানে, এই বিধিনিষেধে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া কিছুটা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। একইসঙ্গে বিপুল সংখ্যাক নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ কাজ হারিয়েছে বা তাদের আয় কমে গেছে এবং কমে গেছে ক্রয়ক্ষমতা। ফলে জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। সরকারি পরিসংখ্যানে অবশ্য বিষয়গুলো সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি।

করোনাকালীন সময়ে আয় হারানো একটি গোষ্ঠী হলো যৌনকর্মীরা। নৈতিকতার বিবেচনায় সমাজে এরা আপাত অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও বাস্তবতার নিরিখে এদের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। মহামারীর এই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও যৌনকর্মীরা ব্যাপকভাবে কাজ হারিয়েছেন, খাওয়া-পরার কষ্টে আছেন। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে বলে একটি গবেষণায় দেখা গেছে। তারা শোষণ-নিরযাতনেরও শিকার হচ্ছেন। আবার এরা প্রায় কেউই সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আসতেও পারছেন না যদিও ২০০০ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশে গণিকাবৃত্তিকে একটি জীবিকা হিসেবে বৈধতা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ পেশাগত শ্রেণিবিন্যাস (বিএসসিও-২০২০) তালিকায় ৫,৪৬০টি পেশার উল্লেখ থাকলেও যৌনকর্মীদের স্থান মেলেনি। যদিও এতে ব্যাক্তিগত সহচর, নৃত্সঙ্গী, ভ্র্রমণ সহচর বা সামাজিক সহচরের মতো পেশাগুলোর উল্লেখ আছে।

করোনার সময়ে যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক বিধি-নিষেধ ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী বেড়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

কোভিডের নেতিবাচক প্রভাবে আয়-উপার্জন হারানোর তালিকায় আছেন কম-বেশি ৫০ লাখ পরিবহন শ্রমিক। বাস চালক ও সহকারী, সিএনজি চালক ও রিকশা চালক–কেউই আর দেড় বছর আগের অবস্থায় নেই বললেই চলে। কয়েক দফা লকডাউনে বিভিন্ন সময়ে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাস ও মিনিবাসের চালক, সহকারী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শ্রমিকেরা বেকার সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু এই দুঃসময়ে তারা সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তা পাননি, আবার মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। অথচ বিভিন্ন সময় প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করা ও কঠোর সড়ক নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নের বিরোধিতায় এই পরিবহন শ্রমিকদেরকেই মাঠে নামানো হয়েছে জনজীবন দুঃসহ করে দিয়ে। আবার বছরজুড়ে ইউনিয়নের নামে চাঁদাবাজি করা হয়ে থাকে, কিন্তু শ্রমিক কল্যাণে কোনো টাকা খরচ করা হয় না ।

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরাও কোভিডের ভুক্তভোগী। অনেকেই ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এরাসহ কিছু পরিবহন শ্রমিক রিকশা চালানোর কাজ বেছে নিয়েছেন যেহেতু লকডাউনে রিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তেমন বাধা ছিল না। এমনকি নিম্নআয়ের চাকুরিজীবী কিছু মানুষও এই পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। তাতে করে আবার রিকশা চালনার কাজে শ্রমিককের যোগান বেড়ে গেছে যা অনেক সময়ই তাদের উপার্জন কমিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়।

দেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের আরেকটি অংশ হলো বাসা-বাড়িতে খেটে খাওয়া মানুষ যারা প্রায় সবাই মহিলা এবং সমাজে ‘কাজের বুয়া' হিসেবে পরিচিত। ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে সাধারণ ছুটি হিসেবে প্রথম লকডাউন আরোপ করা হয় দেশে। এর ধাক্কায় রাজধানী ঢাকা শহরের বাসা-বাড়িতে এই কাজের বুয়া বা গৃহকর্মীদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। জুলাই মাস থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি সাপেক্ষে আবারও তারা অনেকে ধীরে ধীরে বাসা-বাড়িতে কাজে ফিরতে থাকেন। কর্মহীন তিন মাস সময়টায় এরা প্রায় সবাই কোনমতে টিকে গেছেন একাধিক কারণে। অনেক বাড়ি থেকেই বুয়াদের নিয়মিত বেতন দেয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সহায়তাও পেয়েছে। যেসব বস্তিতে এদের বসবাস, সেসবের কোনো কোনোটিতে এক বা দু মাসের ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে বা কম নেয়া হয়েছে। এভাবে করোনা ভাইরাসের প্রথম ধাক্কার পরও বাসা-বাড়ির কাজের ওপর নির্ভরশীল নিম্নআয়ের মহিলাদের একটা অংশ ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন।

যারা কাজে ফিরতে পারেননি বা কাজে ফিরলেও আগের চেয়ে কম বাসায় কাজ করেছেন তারা অনেকেই যখন সুযোগ পেয়েছেন, গ্রামে ফিরে গেছেন। যেসব মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাসায় তারা ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করতো, সেসব পরিবারের অনেকগুলোও কাজ হারিয়ে বা আয় খুইয়ে গ্রামে বা মফস্বলে চলে গেছেন। এরা অনেকেই ঢাকা ছেড়েছেন প্রথম দফা লকডাউনের সময়। আবার কোনো কোনো বাসায় খরচ সামলাতে বুয়াদের কাজ কমিয়ে বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে গৃহকর্মীদের একাংশ কার্যত বেকার হয়ে গেছেন। নতুন বা বিকল্প কাজ না পেয়ে তারা গ্রামমুখী হয়েছেন। আন্তরজাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, বিশ্বে অন্তত ছয় কোটি ৭০ লাখ মানুষ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে যাদের ৮০ শতাংশই নারী যারা কোভিডের সময় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

যেহেতু বাসা-বাড়িতে কাজ করে আয়-রোজগারের বিষয়টি আসলে একটি শ্রেণীর মানুষের তাদের তুলনায় যথেষ্ট স্বচ্ছল শ্রেণীর মানুষের ওপর নির্ভর করে, সেহেতু স্বচ্ছল শ্রেণীর আয় ও ক্রমক্ষমতা কমে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের ওপর নির্ভরশীলদের ওপরে। করোনাকালে বিষয়টি খুব ভালভাবে প্রতীয়মান হলো। আর এই নির্ভরতার বিষয়টি নিম্নআয়ের প্রায় সকল পেশার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এবং তা পারস্পরিক নির্ভরতা।

বিষয়টি আসলে চাহিদা-জোগানের এবং ভোগব্যয়ের। কোভিডের অভিঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট ভোগব্যয় বেড়েছে চার দশমিক ২৩ শতাংশ যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল চার দশমিক ৩৩ শতাংশ আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আবার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভোগব্যয়ের হিস্যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৭৫ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশে। ২০২০-২১ সালের হিসেব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে আয় কমে যাওয়ায় ভোগব্যয় কমেছে, ভোগব্যয় কমায় আবার আয়ও কমেছে- এই চক্রটি এখন জোরদার হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা দলিলে গৃহকর্মী, যৌনকর্মী, পরিবহন শ্রমিকের মতো নিম্নআয়ের মানুষদের কোনো উল্লেখ নেই, এমনকি নেই তাদের জীবনমান উন্নত করার বিষয়ে দুই বা এক বাক্যের কোনো দিক নির্দেশনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিল ঘাটলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

আবার নিম্নআয়ের এসব শ্রমজীবী মানুষ মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত থাকায় তাদের কোনো সঠিক তথ্যভাণ্ডার নেই। ফলে, কী পরিমাণ মানুষ এসব কতোদিন ধরে এসব পেশায় নিযুক্ত, তাদের বয়স ও আয়-ব্যয় কতো, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ও হালনাগাদ কোনো উপাত্ত মেলে না। বাংলাদেশের সর্বশেষ শ্রম শক্তি জরিপ হয়েছে ২০১৬-১৭ সময়কালে। এই জরিপ প্রতিবেদনেও এসব শ্র্রমজীবী মানুষেরও বিষয়ে কোনো আলোকপাত করা হয়নি যদিও বাংলাদেশ পেশাগত শ্রেণিবিন্যাস (বিএসসিও-২০২০) তালিকায় যৌনকর্মী বাদে বাকিদের পেশার উল্লেখ আছে। আর এদের সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত যেটুকু পাওয়া যায়, তার মূল উৎস হলো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপ ও গবেষণা এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠন। ফলে, করোনা ভাইরাসের এই দুঃসময়ে তাদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় নিয়ে আসা বা আয় সুরক্ষা দেওয়ার কাজটিও কঠিন হয়েছে।