বাইরে করোনা, ঘরে ডেঙ্গু

বাইরে করোনা, ঘরে ডেঙ্গু

দেশে করোনা রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে৷ ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে হলে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোও জরুরি৷

ঢাকা শিশু হাসপাতালে ঠাঁই নেই৷ ডেঙ্গু বেডের চেয়ে রোগী অনেক বেশি৷ পুরো হাসপাতালই এখন বলতে গেলে ডেঙ্গু রোতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ৷ তবে শিশু হাসপাতালের চিকিৎকরা বলছেন, তাদের প্রস্তুতির ঘাটতি নেই, কোনো শিশু রোগীকেই তারা ফিরিয়ে দিচ্ছেন না৷

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফি আহমেদ জানান, ২৪ ঘণ্টায় শিশু হাসপাতালে ৫০ জন শিশু ভর্তি হয়েছে ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে৷ এটা এই বছরে সর্বোচ্চ৷ জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ১৭৫ জন৷ তাদের মধ্যে জুন মাসে পাঁচ জন, জুলাই মসে ১০৪ জন আর আগস্টের প্রথম ছয় দিনেই ভর্তি হয়েছে ৬৬ জন৷ গত ২৪ ঘণ্টাতেই ভর্তি হয়েছে ৫০ জন৷ এ বছরে শিশু হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে ৪টি শিশু মারা গেছে৷

শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কিংকর ঘোষ বলেন, ‘‘হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য মোট ১৫টি বেড নির্ধারণ করা আছে৷ সেখানে আমরা শুধু ডেঙ্গুর জটিল রোগীদেরই রাখছি৷ যাদের আইসিইউ প্রয়োজন হয়, তাদের আইসিইউতে পাঠাচ্ছি৷ বাকিদের আমরা অন্য বেডে ভর্তি নিচ্ছি৷ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো শিশুকেই আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি না৷ আমরা একটি র‌্যাপিড রেসপন্স টিম করেছি৷’’

হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফি আহমেদ জানান, ‘‘তবে আইসিইউ নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি৷ আমার ১৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১০টিতে এখন ডেঙ্গু রোগী৷ তাহলে বাকি যাদের আইসিইউ প্রয়োজন তাদের নিয়ে কী করবো৷ খুবই খারাপ অবস্থা৷ আর ডেঙ্গু রোগীর ম্যানেজমেন্টও কঠিন৷ ঘণ্টায় ঘণ্টায় তরল খাবার দিতে হয়৷ তারপরও কাউকে আমরা ফেরাচ্ছি না৷’’

জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে৷ শুরুতে সর্বোচচ পাঁচ বছর বয়সি শিশু রোগী বেশি পাওয়া গেছে৷ এখন যারা আসছে, তাদের বয়স পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে বলে জানান চিকিৎসকরা৷ তবে শুধু শিশু হাসপাতালই নয়, ঢাকার আন্যান্য হাসপাতালেও শিশু রোগী বেশি বলে জানা গেছে৷ শিশু হাসপাতালে শুধু শিশুদেরই ভর্তি করা হয়৷

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ২১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে শুধু ঢাকায়ই ২১১ জন৷ বর্তমানে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এক হাজার ১০ জন৷ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগী চার হাজার ১১৫ জন৷ তাদের মধ্যে তিন হাজার ৯৫ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন৷

ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে এ বছর এ পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন৷ তবে আইইডিসিআর এখনো তাদের মৃত্যু যে ডেঙ্গুতে হয়েছে তা নিশ্চিত করেনি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ আইইডিসিআর জানিয়েছে, মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা বেশ সময় সাপেক্ষ এবং লকডাউনের কারণে দেরি হচ্ছে৷

চলতি বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিন্ত্রণেই ছিল৷ ওই মাসে আক্রান্ত হন ২৭২ জন৷ কিন্তু জুলাই মাসে তা আট গুণেরও বেশি বেড়ে যায়৷ এই মাসে মোট আক্রান্ত দুই হাজার ২৮৬ জন৷ তবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসের শেষে তা ১০ হাজার ছড়িয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷

আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকই শিশু৷ ডা. কিংকর ঘোষ বলেন, ‘‘এবার যে ডেঙ্গু তা ২০১৯ সালের টাইপ- থ্রি৷ ওই সময়ে ঢাকার প্রাপ্ত বয়স্করা এই ডেঙ্গুতে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন৷ একই টাইপে একজন দুইবার আক্রান্ত হবেন না৷ তাই শিশুরা এখন আক্রান্ত হচ্ছে৷’’

ডা. শফি আহমেদ বলেন, ‘‘ডেঙ্গুর এই টাইপটি শিশুদের আক্রান্ত করে বেশি৷ শিশুরা এখন করোনার কারণে বাসায়৷ গরমের কারণে তাদের খালি গায়ে রাখা হয় বা হাফ শার্ট, হাফ প্যান্ট পরানো হচ্ছে৷ ফলে তাদের এডিস মশা কামড়াচ্ছে বেশি৷ এই মশা ডাইনিং টেবিল ও পড়ার টেবিলের নীচে বেশি থাকে৷ আর বাচ্চারা অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে টেবিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে এডিস মশার কামড় খাচ্ছে৷ এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে৷’’

চিকিৎসকরা বলছেন, এবারের ডেঙ্গু হেমোজেরিক৷ রক্ষক্ষরণ হয়৷ আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা গবেষণা করে দেখছি ডেঙ্গু তার ধরন পরিবর্তন করেছে কিনা৷ তবে এখনো তার ফলাফল পাইনি৷ এবার লকডাউনে শিশুরা ঘরে আছে৷ ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা বাড়ি-ঘরের জমানো স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়৷ তাই ঘরে থাকা শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘অনেকেই করোনার কারণে ডেঙ্গু বুঝতে পারছেন না৷ তাই করোনা টেস্টের সঙ্গে ডেঙ্গু টেস্ট করানোও জরুরি৷ তা না হলে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়৷ এবার তা হচেছ৷ ফলে রোগী, বিশেষ করে শিশুরা জটিল অবস্থায় হাসপাতালে যাচ্ছে৷ যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই ভালো৷’’

গত বছর ১২ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৩৯২ জন৷ এবার সাত মাসেই চার হাজার ১১৫ জন৷