জনশক্তি রফতানি কমেছে বাড়ছে শ্রমিক ভোগান্তি

জনশক্তি রফতানি কমেছে বাড়ছে শ্রমিক ভোগান্তি

বিশ্বে করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে বিদেশগামী কর্মী যাওয়ার হার তুলনামূলক কমছে। অন্য দিকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে শ্রমিকরা বিভিন্ন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দুই লাখেরও কম শ্রমিক বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বিগত সময়ের চেয়ে এই সংখ্যা অনেক কম। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল-২০২১ পর্যন্ত সময়ে শ্রমিক যাওয়ার হার অন্য সময়ের চেয়ে মোটামুটি ঠিক থাকলেও মে মাসে অর্ধেকেরও অনেক কম শ্রমিক গেছে। যদিও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তৈরি করা পরিসংখ্যানে জুন ও জুলাই মাসে কতজন শ্রমিক বিদেশে গেছেন, সেই তথ্য উল্লেখ নেই।

অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাওয়ায় শ্রমবান্ধব দেশ সংশ্লিষ্টরা কর্মী নেয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবে এ দুরবস্থার মধ্যেও একমাত্র সৌদি আরবেই এখনো সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী যাচ্ছে। অনেক দিন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (ইউএই) কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে আছে।

চলতি বছরের সাত মাসে জনশক্তি রফতানি বেড়েছে না কমেছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শহিদুল আলম গতকাল শনিবার নয়া দিগন্তকে বলেন, এখনো কর্মী যাওয়ার ফ্লো টা ভালো আছে। সৌদি আরব রানিং আছে। আস্তে আস্তে কুয়েতসহ কয়েকটি দেশে কর্মী যাচ্ছে। ইউরোপের কিছু কিছু দেশেও যাচ্ছে।

তিনি বলেন, সারা বিশ্ব যেখানে অচল হয়ে আছে, সেখানে আমাদের কর্মী যাওয়ার অবস্থা মন্দের ভালো বলে আমি মনে করি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার তো অনেক দিন ধরে বন্ধ। তার পরও আমরা খুবই আশাবাদী। কোভিডে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবার জেগে ওঠার জন্য বিদেশে অনেক শ্রমিক লাগবে। সুতরাং ফ্লাইট চালু হলেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের কর্মীদের চাহিদা বাড়বে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট কর্মী গেছে এক লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩৫ হাজার ৭৩২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৯ হাজার ৫১০ জন, মার্চ মাসে ৬১ হাজার ৬৫৩ জন, এপ্রিল মাসে ৩৪ হাজার ১৪৫ জন ও মে মাসে মাত্র ১৪ হাজার ২০০ জন কর্মী পাড়ি জমান। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গেছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৪ জন কর্মী। আর সর্বনিম্নে রয়েছে মালয়েশিয়া ১৪ জন, কুয়েত ৩০ জন, বাহরাইন ৯ জন, লিবিয়া তিনজন, জাপান তিনজন, ব্রুনাই ১০ জন, মরিশাস ১৪ জন ও ইরাকে তিনজন শ্রমিক যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। অন্য দিকে এ সময়ে নারীশ্রমিক গেছে ২৮ হাজার ৮২৪ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গেছে ১৮ হাজার ৪৩৭ জন।

এ দিকে করোনার এই দুঃসময়ে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রতিনিয়ত পাসপোর্টসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ব্যাপারে বিদেশের মিশনে দায়িত্বরতদের বিশেষ করে শ্রম উইংগুলোতে আরো বেশি তৎপর হওয়া দরকার বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশ্লেষকরা।

গত ৪ এপ্রিল রাত আড়াইটার ফ্লাইটে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন পাবনার বাসিন্দা আইয়ুব আলী। তিনি নয়া দিগন্তের কাছে অভিযোগ করেন, বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কঠোর লকডাউনের মধ্যেও সেখানকার পুলিশ অপারেসি (ধরপাকড় অভিযান) চালাচ্ছে। এর মধ্যে অবৈধদের দেশত্যাগে দেশটির সরকারের দেয়া সুযোগ নিতে গিয়ে রাস্তায় অনেকেই পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এর পরও যারা দেশে ফেরত যেতে হাইকমিশন থেকে আউটপাস সংগ্রহে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই সেখানে যাওয়ার পর ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

মূলত হাইকমিশনের আশপাশে দালালদের উৎপাত আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বন্ধুর পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে। তার জন্য হাইকমিশনে গেলে সেখান থেকে আমাদের পাঠানো হয় হাইকমিশনের আরেকটি শাখায়। সেখানে পাসপোর্টের কাজ হয়। ওই অফিসের আশপাশে দালালরা এসে ধরে পাশের দোকানের ভেতরে নিয়ে ফরম পূরণ করতে। তারা ৪৪ রিংগিটের ব্যাংক ড্রাফটসহ ফরম পূরণ করা বাবদ ১০০ রিংগিট করে আদায় করছে। পরে তাদের কথামতো আবার হাইকমিশনের নির্ধারিত কাউন্টারে গেলে সেখানে পড়তে হয় আরেক ভোগান্তিতে। কাউন্টারে লোক থাকে না। এসব বিষয় কর্তৃপক্ষের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে তিনি মনে করেন। যদিও হাইকমিশন থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে, প্রবাসী ভাইবোনদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পাসপোর্টসহ সব ধরনের সেবা প্রদানে হাইকমিশন সবসময় বদ্ধপরিকর। শুধু মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকরা হয়রানি হচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। একই চিত্র বিরাজ করছে কুয়েত, দুবাই, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।

কুয়েতের বসবাসরত মো: হান্নান শাহ দূতাবাস কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন, ‘আমার পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়ার তারিখ ছিল ১১ জুলাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত তো পাসপোর্ট রেডি হয়েছে কি না তার কোনো আপডেট পাইনি। প্লিজ একটু জানাবেন। আমার আকামার মেয়াদ শেষ হবে যাবে ২২ আগস্ট।

একইভাবে সোহেল উদ্দিন নামের কুয়েত প্রবাসী আরেক কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রবাসীদের হাতে পাসপোর্ট পেতে সময় লাগে ৯০ দিন। কিন্তু ওই পাসপোর্ট আপনাদের কাছে বাংলাদেশ থেকে চলে আসে ৭০ দিন পর। কেন আপনারা প্রবাসীদের পাসপোর্ট ২০ দিন আপনাদের কাছে রেখে দিচ্ছেন। ইদানীং পাসপোর্ট নিয়ে হয়রানি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। একই অবস্থা বিরাজ করছে কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাস, দুবাই কনসাল জেনারেলের শ্রম কাউন্সেলর দফতরসহ বেশ কয়েকটি শ্রমবান্ধব দেশের মিশনগুলোতে। এসব মিশনের বেশির ভাগ সমস্যাই পাসপোর্ট ডেলিভারি-সংক্রান্ত।

এমজে/