‘আট বছর ধরে একই মঞ্চে বাবার জন্য কাঁদছি’

‘আট বছর ধরে একই মঞ্চে বাবার জন্য কাঁদছি’

শনিবার (৩০ আগস্ট) দুপুর, জাতীয় প্রেস ক্লাবের পশ্চিম পাশের মিলনায়তনজুড়ে কেমন যেন এক শূন্যতার অনুভূতি। কেউ কেউ চোখ মুছছিলেন, কেউ পাশেরজনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তাদের কান্না-আবেগের ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছিল অন্যদেরও।

‘আন্তর্জাতিক গুম দিবস’ উপলক্ষে বিভিন্ন সময়ে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের আয়োজনে এসেছেন এরা। উপস্থিতির বেশিরভাগই ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য।

তেজগাঁওয়ের একটি ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ‘নিখোঁজ’ সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তার বড় বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী।

তিনি বলেন, ‘আগে আমার মাকে মনে হতো আমার চেয়ে ইয়াং, এখন তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছেন। ছেলের বিষয়ে এখানে আসাটাও কন্টিনিউ (নিয়মিত) করতে পারছেন না। (সুমন) প্রথম যখন গুম হয়, ব্যাপারটা এমন ছিল যে এই তো ফিরে আসবে। আমার এক চাচা বলতেন, আমি তো বালিশের পাশে চাবি নিয়ে ঘুমাই, ছেলে আসবে দরজাটা তাড়াতাড়ি খুলতে হবে। সেই চাচা চলে গেছেন। আরেক চাচা বলতেন, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেন, না হয় কবরটা দেখিয়ে দেন। সেই চাচাও চলে গেছেন।’

‘এভাবে সংখ্যাটা বাড়ছে। এরা (নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন) তিন/চারজন ছিলেন, আজকে পুরো সারিটা ভরে গেছে।’

মারুফা বলেন, ‘প্রথম যেদিন এখানে এসেছিলাম আমি খুব কেঁদেছিলাম, আমি এখন আর কাঁদি না। আমি এখন এমন কিছু প্রত্যাশা করি, আমরা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবো, বসবো...আমি আর (নিখোঁজ বিএনপি নেতা) ইলিয়াস ভাইয়ের ছেলে প্রোগ্রাম করছিলাম, আমরা র‌্যাব অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, কারণ দুটো ঘটনাই র‌্যাবের। র‌্যাবের লোকজনই তুলে নিয়ে গেছে। তাই র‌্যাবের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদটা জানাব। খুব কাছের সময়ে এই কর্মসূচি পালন করবো।’

‘কষ্টটা সইতে সইতে এমন হয়ে গেছে’, বলতে বলতে গলা ধরে আসে মারুফা ইসলামের। কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকেন—‘মনে হয় যে জীবনের বাকি দিনগুলো বয়ে যাওয়া সত্যি কষ্টকর ভাই ছাড়া। মনে হয় আমার ভাই... এতো ভালো মানুষের যে এমন কিছু হতে পারে, এটা আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল। প্রথম তো দু-তিনদিনের মধ্যে দিয়ে দেবে, এমন একটা আশায় ছিলাম। সেই আশায় থেকেই কতোগুলো মানুষ হারিয়ে গেল।’

তিনি বলেন, ‘আমার মা তিনবেলা খান না, আমরা মাকে লিকুইড (তরল খাবার) খাওয়াই। এই কষ্টটা বড় সন্তান হয়ে আমাকে দেখতে হচ্ছে। স্বাধীন দেশ থেকে গুম হয়ে যেতে হয়, এই বিচার আমি কার কাছে চাইব? যিনি শুনবেন তিনি তো শোনেন না। এতগুলো গলার স্বর যখন শোনেন না, আমারটা যে শুনবেন মনে হয় না। আমাদের এই দিন কোথায় গিয়ে শেষ হবে জানি না।’

‘তবে হ্যাঁ! আশায় বুক বাঁধি, ভাইকে মরার আগে অন্তত একবার ছুঁয়ে দেখব। ওর হাতটা অনেক শক্ত ছিল। ও আমার হাতটা ধরে সবকিছুতে সাহস যোগাতো। আমাকে হাত ধরে বলবে আপু- এই তো আমি!’

তিনি বলতে থাকেন, ‘আমাদের কষ্টটা বুঝুন, আমাদের কষ্টটা বুঝুন। সরকার ইচ্ছে করলেই পারে, শুধু ইচ্ছা!’

সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম বলেন, ‘বাবা ২০১৩ সালে গুম হয়েছেন। আট বছর ধরে একই মঞ্চে এসে একইভাবে কান্না করছি বাবার জন্য, কিন্তু পাচ্ছি না। আমি অনুরোধ করতে চাই না, শুধু বাবাকে ফেরত চাই।’

আরেক নিখোঁজ আব্দুল কাদের ভূঁইয়া মাসুমের মা আয়শা আলী বলেন, ‘কোনো দাবি নেই। অনুরোধ সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। কত কষ্ট একটা জলজ্যান্ত সন্তানকে আট বছর পাচ্ছি না।’

নিখোঁজ সোহেলের শিশুকন্যা সাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আপনারা আমার বাবাকে ফেরত দেন।’

জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া কুষ্টিয়া থেকে স্বামী সাজ্জাদুল ইসলাম সবুজের খোঁজ চেয়ে বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।