এসজিআরএ’র ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞদের মত

ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ভুল বার্তা দিচ্ছে

ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ভুল বার্তা দিচ্ছে

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রত্যাবাসন বিষয়টি মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদেরও অংশগ্রহণও জরুরি। বিশ্লেষকরা আরও মনে করছেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়টি মিয়ানমারকে ভুল বার্তা দিতে পারে। মিয়ানমার হয়তো ভাবছে, বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে। একই বার্তা আন্তর্জাতিক মহলেও যাচ্ছে। স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স (এসজিআরএ) আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা এ মত দেন।

এসজিআরএ’র প্রধান নির্বাহী আমির খসরুর সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নূর খান এবং কক্সবাজার এনজিও ফোরামের কো-চেয়ারম্যান আবু মুর্শেদ চৌধুরী।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর পশ্চিমাদের ভুল বার্তা দিয়েছে।

তারা মনে করছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে আশ্রয় দিচ্ছে। সরকারের কৌশলের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পে অস্ত্র ও মাদক আসছে। সেখানে সঠিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। মুহিবুল্লাহ ক্যাম্পে জনসভার আয়োজন করেছিলেন দুই লাখ লোক নিয়ে। এরপর সরকার তার অফিস বন্ধ করে দেয়। মুহিবুল্লাহ হত্যার পর ক্যাম্পে অপরাধীদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে।

প্রত্যাবাসনের সঙ্গে মুহিবুল্লাহ হত্যার সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তার মতে, এটা আন্তঃনেতৃত্ব কনফ্লিক্ট হতে পারে। মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যথেষ্ট সক্রিয়। পক্ষান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যথেষ্ট দুর্বল। ফেব্রুয়ারি ২০২১ এর পরে সু চি ক্ষমতাচ্যুত হন। এক হাজারের বেশি লোক মারা যান। কিন্তু কেউ সেখানে সুযোগ নিতে পারলো না। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বোঝাতে হবে, সামরিক বাহিনী যারা ক্ষমতায় আছে তারা দুর্বল। এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়া দরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডি-কাপলিং পলিটিক্স করতে পারে। চীন, জাপান এবং ভারত মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। চীনকে বাদ দিয়ে জাপান এবং ভারতকে বোঝাতে হবে রোহিঙ্গাদের ডি-কাপল করো তোমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে। রোহিঙ্গা যুবকরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে- এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করে তিনি বলেন, সত্তরের দশক, নম্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গারা এসেছে, ২০১৭ সালে আসলো। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমরা এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড দেখিনি। সুতরাং একটা জনগোষ্ঠীর ওপর এভাবে দায় চাপিয়ে দেয়া উচিত হবে না।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পূর্ববর্তী রোহিঙ্গা নেতাদের অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বশূন্যতা ছিল। মুহিবুল্লাহ সেখানে নেতৃত্বে আসেন। আন্তর্জাতিক মহলে সুনাম ছিল তার। রোহিঙ্গা ভয়েস বলতে যে আরএফ, আরএসও’কে বোঝাতো তারা বর্তমানে বিচ্ছিন্ন। যে কারণে মুহিবুল্লাহ উঠে এসেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে গেছেন। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন তিনি। যা ক্রমেই মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত আরও বলেন, আমার বিশ্বাস মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা কক্সবাজারে কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতে পারে, বাইরেরও হতে পারে। শতবছর থেকে থাকা তারা এই অঞ্চলে সক্রিয়। সামরিক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে তাদের তৎপরতা বেড়েছে। তাদের অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা আছে। ২০১২-১৭ পর্যন্ত রোহিঙ্গা নিধনে তাদের তৎপরতা ছিল বেশি। যে দাঙ্গা হয়েছিল সেটার পেছনে কৌশল ছিল এদের। এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, মুহিবুল্লাহ গোয়েন্দা সংস্থার টার্গেট হতে পারে। যুবকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য তাকে হত্যা করা হতে পারে। এতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশ আছে কিনা সেটা নিয়ে শঙ্কিত। কক্সবাজার যাতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবির না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ২০১৭ সালে যখন বাংলাদেশ মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলো- সেখানে সময়ক্ষেপণের প্রক্রিয়া ছিল। চুক্তিতে রোহিঙ্গা জনগণের মতামত নিয়েছে কিনা সেটা আমরা দেখিনি। আমরা মিয়ানমারকে চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থানে আনতে পারেনি। প্রত্যাবাসনের জন্য যে যে কাজ করা দরকার সেগুলো কোনো পক্ষ থেকে হয়নি। সমস্যা মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে। কিন্তু এখানে বাংলাদেশকে জড়ানো হচ্ছে। পরবর্তীতে দুইবার উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কারণ চুক্তিতে সমস্যা ছিল। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য।
তিনি আরও বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে প্রত্যাবাসন সম্ভব না, এটা ভুল। দুইটা জিনিস। স্বাভাবিক কারণে এটা দীর্ঘায়িত হতে পারে। জাতিসংঘের সঙ্গে যে চুক্তি করতে যাচ্ছি, ভাসানচরে তাদের স্থানান্তরের মধ্যদিয়ে ভুল মেসেজ মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেতে পারে। সীমান্তে তাদের রাখা হলে দেশে ফেরার একটা আকাঙ্ক্ষা থাকতো। এ সমস্যার পূর্ণ সমাধান রয়েছে প্রত্যাবাসনের মধ্যে। রোহিঙ্গাদের মতামত ও প্রস্তুতি নিয়েও আলোচনা করতে হবে। সব পক্ষকে যুক্ত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।

কক্সবাজার এনজিও ফোরামের কো-চেয়ারম্যান আবু মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা যুবকরা বেকারত্বের কারণে মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখা যেত। এ জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। সরকারের উচিত ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে মিয়ানমারের কাছে কী বার্তা যাচ্ছে তা জানার চেষ্টা করা।

সমাপনী বক্তব্যে এসজিআরএ’র প্রধান নির্বাহী ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আমির খসরু বলেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য সিভিল সোসাইটি, গবেষণা সংস্থার সম্পৃক্ততা দরকার। সরকারের উদ্যোগকে আরও দৃশ্যমান করতে হবে। কূটনীতির ক্ষেত্রে বড় দেশ ও দাতা সংস্থার নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। রোহিঙ্গা যুবকদের জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশংকা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা বলছি না তারা উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু তারা যদি কোনো কাজের মধ্যে না থাকে তাহলে এ সম্ভাবনা রয়েছে। এটা মনোজগতের বিষয়। যেকোনো সময় সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়ে আরও গবেষণা দরকার।