গ্যাস উৎপাদনের ৬৩ ভাগ বিদেশী দখলে

গ্যাস উৎপাদনের ৬৩ ভাগ বিদেশী দখলে

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ সীমিত হয়ে আসছে। অন্য দিকে গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বর্ধিত চাহিদা মেটাতে গ্যাস উৎপাদনে বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি। তবে গ্যাস উৎপাদনে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। দুই যুগের ব্যবধানে দেশের মোট গ্যাসে উৎপাদন ৬৫ ভাগ চলে গেছে বিদেশী কোম্পানিগুলোর দখলে। যেখানে ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত দেশের গ্যাস উৎপাদনের পুরোটাই করত দেশীয় কোম্পানিগুলো। কিন্তু গত দুই যুগে তা কমতে কমতে এখন ৩৫ ভাগে নেমে গেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাস উৎপাদনে বিদেশী নির্ভরশীলতা বৃদ্ধিতে বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকির পরিমাণ। তাদের অবৈধ শর্ত মেনে না নিলে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বলা চলে দেশ জিম্মি হয়ে পড়ছে বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর।

গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে এলএনজির আমদানি বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। অন্য দিকে বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির দাম। এতে এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ও বাড়ছে। জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ; কিন্তু জ্বালানি সঙ্কটের কারণে শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়। বর্তমানে দরপত্রের মাধ্যমে স্পট মার্কেট থেকে কেনা হচ্ছে তিন কার্গো এলএনজি। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়ার কাছ থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ ২৯ ডলার ৮৯ সেন্ট মূল্যে এক কার্গো এলএনজি এরই মধ্যে কিনেছে বাংলাদেশ। যেখানে জানুয়ারিতে ছিল ১৪ ডলার। এভাবে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে সামগ্রিক ভর্তুকির পরিমাণ।

এ দিকে গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত দেশের চাহিদার পুরো গ্যাস উৎপাদন করত দেশের জাতীয় তিন কোম্পানি; কিন্তু ১৯৯৮ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জির মাধ্যমে দেশের গ্যাস সরবরাহে বিদেশী কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছর সমুদ্র্রবক্ষে আবিষ্কৃত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। ২০০৪ সালে দেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের ৭৬ শতাংশ অবদান ছিল দেশীয় কোম্পানিগুলোর। তখন ২৪ শতাংশ গ্রাস উৎপাদন করত বিদেশী কোম্পানিগুলো। ১৪ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ চলতি বছরে গ্যাস উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অবদান কমে নেমে আসে ৩৫ শতাংশে। আর বিদেশী কোম্পানিগুলোর অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশ। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ৭ অক্টোবর প্রায় ২৪৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করেছে ৮৬ কোটি ঘনফুট এবং বিদেশী কোম্পানিগুলো উৎপাদন করেছে প্রায় ১৫৮ কোটি ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে তিনটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরন তিনটি গ্যাসক্ষেত্র যেমন, জালালাবাদ, মৌলভীবাজার, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি তাল্লো বাংগোরা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করত। ওই অর্থবছরে দেশের মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৫২ শতাংশ উৎপাদন করে এ তিনটি বিদেশী কোম্পানি। কিন্তু অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর থেকে দু’টি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ গ্যাস উত্তোলন করছে শেভরন।

পেট্রোবাংলার এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করতে বলা হচ্ছে। যেখানে উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা, সেখানে কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় শতভাগ। এর ফলে এক দিকে বিদেশী কোম্পানিগুলো স্বল্প সময়ে বাড়তি উৎপাদন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিচ্ছে, তেমনি গ্যাসের মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, যা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপই বলা চলে।

এ দিকে গ্যাসের মজুদ কমে আসায় আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে এলএনজির বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা লাগামহীন হয়ে উঠছে। জানুয়ারিতে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল প্রায় ১৪ ডলারে। এখন তা আমদানি করা হচ্ছে প্রতি এমএমবিটিইউ ২৯ ডলার ৮৯ সেন্ট করে। উচ্চমূল্যে আমদানি করায় বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকির পরিমাণ।

প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্কট বিবেচনায় ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। সামিট এলএনজি ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জির স্থাপন করা ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি এফএসআরইউর সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট। তিন-চার বছরের মধ্যে প্রতিদিন ৪০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বর্তমানে জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন লাইনে প্রতিদিন ৬০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে।

এমজে/