খালি হাতে ফিরছেন অনেকে

টিসিবির পণ্য কেনার ভিড়ে নতুন মুখ

টিসিবির পণ্য কেনার ভিড়ে নতুন মুখ

লাঠিতে ভর দিয়ে দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর অবশেষে তৃপ্তির হাসি সত্তরোর্ধ্ব শেখ নাসিরুল আলমের চোখেমুখে। তার বাঁ হাতে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ। তাতে আছে দুই লিটার সয়াবিন তেল এবং দুই কেজি চিনি। সাশ্রয়ী দামে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে পণ্য দুটি কিনে রওনা হয়েছেন বাসার উদ্দেশে।

গতকাল বিকেল ৩টার দিকে বাসায় ফেরার পথে মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনি এলাকায় শেখ মো. নাসিরুল আলমের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার সময় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। অপেক্ষার পালা শেষে টিসিবির তেল ও চিনি কিনতে পেরে বেশ খুশি তিনি। টিঅ্যান্ডটি কলোনির পাশে নিজের একটি টিনশেড বাড়িতে বসবাসকারী নাসিরুল আলম বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে ন্যায্যমূল্যের জিনিস কিনতে হচ্ছে। যে টাকা সাশ্রয় হয়েছে, তা দিয়ে অন্য কিছু কেনা যাবে।

গতকাল টিঅ্যান্ডটি কলোনি এলাকা ছাড়াও ফার্মগেট, হাতিরঝিলের মধুবাগ, তেজগাঁওয়ের সিদ্দিক মাস্টারের ঢালসহ কয়েকটি স্থানে টিসিবির পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় শত শত ক্রেতাকে। যাদের বড় একটি অংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের কেউ পণ্য কিনতে পেরেছেন, আবার কেউ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছেন।

দুপুর সাড়ে ১২টায় ফার্মগেটের ছন্দ সিনেমা হলের সামনে টিসিবির ট্রাকের পেছনে নারী-পুরুষের দুটি সারি দেখা যায়। তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে ট্রাকের পণ্য। পুরুষের সারিতে ছিলেন ২২ এবং নারী সারিতে ১৯ জন। মোট ৪১ জনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত চারজন তেল এবং চিনি পেয়েছেন। আর তিনজন পেয়েছেন শুধু চিনি। বাকি ৩৪ জনকে দেখা গেছে হতাশার কালো মুখ নিয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে।

ফার্মগেটে ট্রাক থেকে পণ্য না পেয়ে তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ূয়া মেয়ে সীমার হাত ধরে বাসায় ফিরছিলেন জাহানারা বেগম। ওড়না দিয়ে মুখ আড়াল করে তিনি বলেন, তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কিছুই পাননি। সপ্তাহে দুই-তিন দিন এখানে ট্রাক আসে। এ নিয়ে মোট চার দিন খালি হাতে ফিরতে হলো তাকে।

টিসিবির পণ্যে কেমন সাশ্রয় হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। দিন দিন দাম আরও বাড়ছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন স্বামী। যে বেতন পান তাতে ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। চার-পাঁচ দিন দাঁড়ানোর পর একবার পেলেও অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বাঁচে। সরকার পণ্য বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়ালে তাকে খালি হাতে ফিরতে হতো না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন এই ভোক্তা।

মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনি থেকে মধুবাগে ন্যায্যমূল্যের পণ্য কিনতে এসেছেন স্নাতক পড়ূয়া রাসেল আহমেদ। থাকেন এখানকার সরকারি কলোনিতে। বাবা টিঅ্যান্ডটিতে একটি ছোট পদে চাকরি করেন। নিজ এলাকায় সবাই চিনে ফেলবে বলে একটু দূরে মধুবাগে কম দামে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত শুধু পেঁয়াজ আর তেল পেয়েছেন তিনি। রাসেল বলেন, টিসিবির পণ্য কেনার লাইনে এখন বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকে। আবার লোকলজ্জায় অনেকে লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না।

এদিকে প্রতিদিনই পণ্য না পেয়ে অনেক ক্রেতাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে মধুবাগে টিসিবির ট্রাকের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, টিসিবি থেকে দৈনিক জনপ্রতি যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ থাকে ক্রেতার লাইন। এ কারণে সবাইকে দেওয়া যায় না। ফলে যারা লাইনের পেছনের দিকে থাকেন, তারা পণ্য পান না।

গত ৩ নভেম্বর থেকে আবারও ন্যায্যমূল্যে বোতলজাত সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। একজন ক্রেতা টিসিবির ট্রাক থেকে প্রতি লিটার ১১০ টাকা করে সর্বোচ্চ দুই লিটার সয়াবিন তেল, ৫৫ টাকা কেজি দরে দুই কেজি চিনি এবং ৬০ টাকা দরে দুই কেজি ডাল কিনতে পারেন। এ ছাড়া পেঁয়াজ কিনতে পারছেন দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত। প্রতি কেজির দাম ৩০ টাকা।

টিসিবির তথ্যমতে, মহানগর, জেলা ও উপজেলায় ৪০০ থেকে ৪৫০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে এই বিক্রি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতি শুক্রবার ছাড়া তা চলবে আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৭০০ লিটার সয়াবিন তেল ও ৪০০ কেজি করে চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনার কারণে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লোকসানের ভারে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। গত মাসে মূল্যস্ম্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে মূল্যস্ম্ফীতির হার আরও বেশি বলে মনে হয়।

তিনি বলেন, একদিকে অনেকের আয় কমেছে। অন্যদিকে মূল্যস্ম্ফীতি বেড়েছে। করোনার আগে যে পরিমাণ আয় হতো, এখনও সে আয়ে ফিরে যেতে পারেনি মানুষ। এসব কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তারা টিসিবির পণ্য কেনার সারিতে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। এই দীর্ঘ সারি প্রমাণ করে- শুধু স্বল্প নয়, মধ্যম আয়ের মানুষেরও ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। নতুবা রোদে পুড়ে কষ্ট করে কেউ লাইনে দাঁড়াত না।-সূত্র : সমকাল