কে শোনে কার কথা? চলছে নৈরাজ্য, অসহায় যাত্রীরা

কে শোনে কার কথা? চলছে নৈরাজ্য, অসহায় যাত্রীরা

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ধর্মঘটের মুখে ডিজেল চালিত বাসের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। এই সুযোগে যাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, বাসে ওয়েবিল সিস্টেম ও সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। প্রতিটি গাড়িতেই ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বাগবিতণ্ডা চলছে। চলছে যাত্রী হয়রানি ও অপমান। ভাড়া নৈরাজ্যে অসহায় হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা।

এ নৈরাজ্য দূর করার জন্য গত বুধবার থেকে অভিযানে নেমেছে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু কাজে আসছে না এই অভিযান। ডিজেল ও সিএনজিচালিত বাসে স্টিকার লাগানোর কথা থাকলেও তা চোখে পড়েনি। রাজধানীতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গ্যাসচালিত গাড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি রুটে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে গণপরিবহন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হুঁশিয়ারি, বিআরটিএ’র মোবাইল কোর্ট ও মনিটরিংয়েও বশে আনা যাচ্ছে না গণপরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের। এ কারণে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা।

সরকারিভাবে সতর্ক করে বলা হয়েছে, রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস, ওয়েবিল চলবে না, কিন্তু বৃহস্পতিবারও (১১ নভেম্বর) এই সিস্টেমে গাড়ি চলেছে। বর্ধিত এই ভাড়া কেবল ডিজেলচালিত বাসের জন্য কার্যকরের কথা থাকলেও গ্যাসচালিত গাড়িতে নতুন বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত হলেও সরেজমিন পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে উল্টো চিত্র।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন রুট ঘুরে দেখা যায়, ডিজেলচালিত বাসের পাশাপাশি সিএনজিচালিত বাসও ভাড়া বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পড়ছে দুই টাকারও বেশি। কোথাও কোথাও আবার তা সাড়ে তিন থেকে চার টাকা। অথচ সরকারিভাবে শহরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আন্তজেলা বাসের ক্ষেত্রে ২৭ শতাংশ। নতুন ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি বাস কর্তৃপক্ষেরই দাবি, তাদের গাড়ি গ্যাসে নয়, ডিজেলে চলে। গাড়িতে গ্যাসের মিটার খুলে রাখা হয়েছে। প্রায় গাড়িতেই গ্যাসের মিটারের সঙ্গে সংযোগ তারটি ঝুলতে দেখা গেছে।

রাস্তার এই নৈরাজ্য বিআরটিএ মনিটরিং করছে, তবে সংখ্যায় কম হওয়ায়, এর কোনও সুফল যাত্রীরা পাচ্ছেন না। এই অভিযান বা মনিটরিং বাস মালিক বা শ্রমিকদের কাছে তেমন কোনও গুরুত্বও পাচ্ছে না। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, ভাড়া সমন্বয়ের ঘোষণার পর থেকেই বাসগুলো স্বেচ্ছাচার স্টাইলে যাত্রীদের পকেট থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ৪ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ায় সরকার। এর পরদিন থেকেই দাম কমানোর দাবি বাদ দিয়ে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেন গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। সড়ক পথে তিন দিন এবং নৌপথে দু’দিন ধর্মঘটের পর সরকারিভাবে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৮ নভেম্বর) থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে বাস ও লঞ্চ মালিক সমিতি। এরপর থেকেই শুরু হয় নৈরাজ্য।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনকেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সড়কে মোবাইল কোর্ট তেমন চোখে না পড়ায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বলছেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর এমন হুঁশিয়ারি নতুন কিছু নয়। দু’দিন ধরেই এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছেন তিনি। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উনি হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন, আর বাসচালক, মালিক ও শ্রমিকরা তাদের কাজ করেই যাচ্ছেন। নতুন ভাড়া আদায়ের নামে বাস মালিক-শ্রমিকদের হরিলুট চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানবন্দর থেকে মিরপুর ১২ নম্বরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এই রুটে চলাচলকারী বাস বসুমতি ও প্রজাপতি পরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ৪০ টাকা। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া নিচ্ছে তিন টাকা ৩৩ পয়সা। অথচ আগে ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। আবার মিরপুর ১২ নম্বর থেকে যমুনা ফিউচার পার্কের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। এই রুটে চলাচলকারী বাস নূরে মক্কা, অছিম পরিবহন নতুনভাবে ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা হারে। এখানে প্রতি কিলোমিটারে নিচ্ছে তিন টাকা। বাড়ানোর আগে এই রুটের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা।

যাত্রীরা বলছেন, রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে চেকের নামে যাত্রীদের পকেট কাটছে বাস কর্তৃপক্ষ। লোকাল বা সিটিং বাসের বালাই নেই, যে যার মতো ভাড়া আদায় করছে। জিম্মি হয়ে আছেন যাত্রীরা। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার। এই পথের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এখন নতুনভাবে ভাড়া নিচ্ছে ৩৫ টাকা। এই রুটে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া পড়ছে এক টাকা ৮৪ পয়সা। একইভাবে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে নিউমার্কেটের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এই রুটে ভাড়া ১০ টাকা বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে ৩৬ টাকা; যা আগে ছিল ২৬ টাকা। এই রুটে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে দুই টাকা ৭৬ পয়সা।

এদিকে, বুধবার (১০ নভেম্বর) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছিলেন, সিটিং সার্ভিসে কোনও নিয়মনীতি নেই। তারা নিজের মতো যাত্রী পরিবহন করে। এতে ভোগান্তি হয় যাত্রীদের। তাই সিটিং বা গেটলক সার্ভিস থাকবে না।

তিনি জানিয়েছেন, বলা হচ্ছে ঢাকা এবং দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সিএনজিচালিত। এসব বাসে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ১২০টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৩ কোম্পানির ১৯৬টি বাস সিএনজিচালিত পেয়েছি। এটি মোট গণপরিবহনের মাত্র ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ।

এনায়েত উল্যাহ জানান, আগামী তিন দিনের মধ্যে ডিজেল ও সিএনজিচালিত বাসে স্টিকার লাগানো হবে। আর অতিরিক্ত ভাড়া যাতে নিতে না পারে সে জন্য মালিক-শ্রমিকদের সমন্বয়ে ১১টি ভিজিল্যান্স টিম মাঠে থাকবে।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) কোথাও কোনও গাড়িতেই ডিজেল ও সিএনজিচালিত স্টিকার দেখা যায়নি। রাস্তায় চোখে পড়েনি মালিক-শ্রমিকদের সমন্বয়ে কোনও ভিজিল্যান্স টিম।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ভাড়া নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করবে বিআরটিএ। বিআরটিএ অভিযান পরিচালনা করছে। এই অভিযান চলবে।