চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয়া হয় শিশু মরিয়মকে

চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয়া হয় শিশু মরিয়মকে

নির্মম! মর্মান্তিক!! হৃদয় বিদারক!!! ভিক্ষা চাইতে বাসে উঠেছিল মাত্র ১০ বছর বয়সী কন্যা শিশু মরিয়ম। কিন্তু পাষাণ চালক ও তার সহকারী ৪০ কিলোমিটার গতির চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয়। গুরুতর আহত হয়ে শিশুটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

অভাব-অনটনের সংসারে অর্থের যোগান দিতে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামে মরিয়ম। সারা দিন মানুষের কাছে হাত পেতে যা পেতো তুলে দিতো বাবার হাতে। গাড়িচালক বাবা সেই টাকা খরচ করতেন পরিবারে। প্রতিদিনের মতো মরিয়ম গত ৯ই নভেম্বর ভিক্ষা করতে বাসা থেকে বের হয়। বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ভিক্ষা চাইতে চাইতে সে ভাটারা থানা এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টোপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাইদা পরিবহনের একটি বাসে ওঠে।

কিন্তু চালকের সহকারী সিটিং সার্ভিস বাসের অজুহাত দিয়ে মরিয়মকে বাস থেকে নামানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে। ততোক্ষণে বাস দ্রুত বেগে চলতে শুরু করে। চালকের সহকারী প্রথমবার চালককে বাস থামাতে বলে কিন্তু থামায়নি চালক। দ্বিতীয়বার বলাতে চালক বিরক্ত হয়ে গতি কিছুটা কমায়। কিন্তু মরিয়ম নামতে নামতে চালক গতি আবার বাড়িয়ে দেয়। এ সময় চালকের সহকারী মরিয়মকে বাস থেকে ফেলে দেয়। ছিটকে রাস্তায় পড়ে মরিয়মের দেহ। গুরুতর আহত অবস্থায় মরিয়ম ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ঘাতক বাসের চালক ঝামেলা এড়াতে দ্রুত বাস নিয়ে পালিয়ে যায়।

মরিয়মের মৃত্যুর পরপরই দেশজুড়ে চাঞ্চল্যর সৃষ্টি হলেও তার পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর বিষয়ে জানতে পারে ঘটনার দিন বিকাল বেলা। দিনভর বাড়ি না ফেরায় তাকে খুঁজতে বের হন তার বাবা রনি মিয়া। কোথাও মেয়ের সন্ধান না পেয়ে পরে জানতে পারেন ভাটারা থানায় একটি মেয়ে শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। রনি মিয়া ভাটারা থানায় গিয়ে মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করেন। পাশাপাশি ওই রাতেই অজ্ঞাতনামা গাড়িচালককে আসামি করে ভাটারা থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা করেন। যার নং-২৯। থানা পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে র‌্যাব। একপর্যায়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১ এর অভিযানে শুক্রবার রাতে ঢাকার টঙ্গী এবং আব্দুল্লাহপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাইদা পরিবহনের চালক রাজু মিয়া (২৫) ও চালকের সহকারী ইমরান হোসেন (৩৩)কে গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাব জানিয়েছে, মূলত বাস না থামিয়ে মরিয়মকে ফেলে দেয়ার জন্য তার মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটি সম্পূর্ণ ক্লু-লেস ছিল। তাই প্রায় ৫০টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বাস ও ঘাতকদের শনাক্ত করা হয়। রাজুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আর ইমরানের বাড়ি শ্যামপুরের বৌবাজারে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা উক্ত নির্মম, হৃদয় বিদারক অকাল মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে। গতকাল কাওরানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‌্যাব পরিচালক বলেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের বিপরীত পাশে ফুটপাতের উপর অজ্ঞাত এক মেয়ে শিশু আহত হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন পথচারীরা। উপস্থিত পথচারীরা মেয়ে শিশুটিকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য পথচারীরা শিশুটির মৃতদেহ নিয়ে পুনরায় ঘটনাস্থলে আসেন। পরবর্তীতে ভাটারা থানা পুলিশ সংবাদ পেয়ে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

এদিকে ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব মরিয়মের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে তার পরিবার, প্রতিবেশী এবং মৃতদেহ পড়ে থাকার ঘটনাস্থলে অবস্থানরত ব্যক্তিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে র‌্যাব জানতে পারে মরিয়ম পরিবারের সাথে খিলক্ষেত থানার কুড়াতলী এলাকায় থাকতো। তার পিতা রনি প্রাইভেটকার চালক। ২০১৯ সালে মরিয়ম স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলে অর্থের অভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আর্থিক সহায়তার জন্য মরিয়ম বাড়ি থেকে কুড়িল এবং এর আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়াতো। ঘটনার দিনেও সে সকাল সাড়ে ৬টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পথচারী এবং বাস যাত্রীদের নিকট ঘুরে ঘুরে সাহায্য চাচ্ছিল।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে র‌্যাব’র এ কর্মকর্তা বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় মরিয়ম হেঁটে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে যমুনা ফিউচার পার্কের বিপরীত পাশে আসে। এরপর সে রাইদা সিটিং সার্ভিসের একটি বাসে ওঠে। বাসটি সামনে যেতেই একজন পথচারীকে হাত দিয়ে ইশারা করতে থাকে। সিসিটিভি ক্যামেরার একটি ফ্রেমের ঠিক পেছনে ভিকটিম মরিয়মকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। সিসিটিভি ক্যামেরার অবস্থান এবং সময় বিবেচনা করে নিশ্চিত হওয়া যায়, এখানেই মৃত্যু হয় শিশু মরিয়মের।

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে খন্দকার আল-মঈন বলেন, ঘটনার দিন সকালে চালক রাজু মিয়া ও তার সহকারী ইমরান হোসেন প্রতিদিনের মতোই রাইদা পরিবহনের বাস (ঢাকা মেট্রো ব- ১৪-৯০২২) নিয়ে পোস্তগোলা হতে দিয়াবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা করে। সকাবেলা যাত্রীর সংখ্যা কম থাকায় রাজু দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। বাসটি প্রগতি সরণি যমুনা ফিউচার পার্কে পৌঁছালে ভুক্তভোগী মরিয়ম বাস যাত্রীদের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার জন্য বাসে ওঠে। এ সময় বাসের সহকারী ইমরান হোসেন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছিল। সে তখন লক্ষ্য করে, মরিয়ম গাড়িতে উঠে যাত্রীদের কাছে অর্থ সাহায্য চাচ্ছে। তাই তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চালককে গাড়ির গতি কমাতে বলে। মরিয়মকে তখন দরজার কাছে নিয়ে নেমে যেতে বলে। ইমরানের কথায় চালক রাজু বাস থামায়নি। কিছুদূর না যেতে ইমরান আবার রাজুকে বাস থামাতে বলে। এতে করে রাজু বিরক্ত হয়ে বাসের গতি কিছুটা কমিয়ে মরিয়মকে দ্রুত নামতে বলে। কিন্তু মরিয়ম তাড়াহুড়া করে নামার সময় হঠাৎ করে চালক রাজু গাড়ির গতি আবার বাড়িয়ে দেয়। এতে করে মরিয়ম বাসের দরজা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। মরিয়মের রাস্তায় ছিটকে পড়ার দৃশ্য দেখে গাড়িতে থাকা কিছু যাত্রী এবং রাস্তার পথচারীরা গাড়িকে থামাতে বলেন। কিন্তু চালক বাস না থামিয়ে দ্রুতবেগে দিয়াবাড়ীর দিকে চলে যায়।

র‌্যাব’র জিজ্ঞাসাবাদে চালক রাজু জানায়, তাদের বাসের ঠিক পিছনেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বাস ছিল। শিক্ষার্থীরা বাসে ভাঙচুর এবং মারপিট করতে পারে এই ভয়ে তারা ঘটনাস্থলে বাস না থামিয়ে দ্রুত সামনের দিকে চলে যায়। পরবর্তীতে রাজু ও ইমরান দিয়াবাড়ী থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ফিরতি ট্রিপ নিয়ে আসার সময় জানতে পারে তাদের বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া মেয়ে শিশুটি মারা গেছে। এই খবর পাওয়ার পরপরই তারা বাসটি পোস্তগোলায় হাসনাবাদের একটি বাস ডিপোতে রেখে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর বিষয়টি কাউকে বলেনি। র‌্যাব জানায়, বাসচালক রাজু মিয়া প্রায় ৬ বছর ধরে রাইদা পরিবহনের গাড়ি চালায়। পোস্তগোলা হতে বাড্ডা-দিয়াবাড়ী পর্যন্ত প্রতিনিয়ত রাইদা পরিবহনের বাসচালক হিসেবে কাজ করছিল। আর তার সহকারী ইমরান হোসেন আগে পোশাক কারখানায় কাজ করতো। গত ছয় মাস ধরে রাইদা পরিবহনে সহকারী হিসেবে কাজ করছে।

সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল-মঈন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। বাসে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। আমরা অর্ধশতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বাসটিকে শনাক্ত করেছি। বাসের ও চালকের সঠিক কাগজপত্র ছিল কি না জানতে চাইলে র‌্যাব’র এ কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে তাদের সব কাগজপত্র সঠিক ছিল। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আমরা তদন্ত করবো। অপর এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, বাসটি গেটলক সার্ভিস ছিল। তাই মেয়েটিকে ইমরান দ্রুত নেমে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। মরিয়মকে নামানোর সময় বাসের গতি ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার।