১১ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংক, মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত বছর গ্রেপ্তার দুজন ব্যাংক কর্মকর্তা (বরখাস্ত) ও দুদকের এক সাবেক কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকা। নামে–বেনামে তাঁরা প্রতিষ্ঠান করেছেন, কিনেছেন জমি, দামি গাড়িও। সম্পদের তথ্য লুকাতে তাঁরা স্ত্রীর পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক হিসাবে লাখ লাখ টাকা জমা রেখেছেন।
বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা পাচারের বিষয়টি জানতে পারে পুলিশ। তখন এই তিনজনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাড্ডা থানায় অর্থ পাচার আইনে মামলা করা হয়।
এই তিন আসামি হলেন অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামাণিক (বরখাস্ত), জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা রকিবুল হাসান (বরখাস্ত) এবং দুদকের সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) মফিজুর রহমান।
মামলার বাদী ও সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন (২০০৯–২০২০ সাল) ধরে চক্রটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অর্থ পাচারে তাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
গত ডিসেম্বরে ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পরপর সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এই চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকের দুইবারের নিয়োগ পরীক্ষা, ২০১৯ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটের ২০১৭ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন।
মানিকের ব্যাংক হিসাবে চার কোটি টাকার তথ্য
অগ্রণী ব্যাংকের বরখাস্ত কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামাণিকের বেতন-ভাতা বিশ্লেষণ করে সিআইডি মামলায় বলেছে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মানিক কুমারের মূল বেতন ছিল ২৪ হাজার ২৬০ টাকা। বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সব মিলিয়ে পেতেন ৩৫ হাজার ৪৬৪ টাকা। অথচ তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট মোট নয়টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই সব ব্যাংক হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪৯ টাকা। আর ওই সব ব্যাংক হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয় ৪ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৭ টাকা। মানিক ৪৮ লাখ টাকা দিয়ে নিসান ব্র্যান্ডের জিপ গাড়ি কেনেন ও ৪ কোটি টাকা দিয়ে রাজশাহীতে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানান।
মামলায় আরও বলা হয়, মানিক অপরাধলব্ধ আয়ের তথ্য আড়াল করতে ছদ্মনামে রেবা ট্রেডার্স নামের ব্যাংক হিসাব খুলে টাকা লেনদেন করেন।
মানিকের ব্যাংক হিসাবের বিস্তারিত তথ্য পর্যালোচনা করে সিআইডি বলেছে, অগ্রণী ব্যাংকে মানিক কুমার প্রামাণিকের তিনটি হিসাবে যথাক্রমে ১ কোটি ১৬ লাখ ৮ হাজার ৯৬ টাকা, ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা ও ৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৬১ টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সিটি ব্যাংকে মানিকের ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ৫০ লাখ ৮৬ হাজার ৭৪০ টাকা।
এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকে মানিকের স্ত্রী রিপা রানী মণ্ডলের হিসাবে পাওয়া গেছে ৯০ লাখ ২০ হাজার ৮২৫ টাকা। আর মানিকের ছোট ভাই হীরা কুমারের ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ২০ টাকা।
মামলায় বলা হয়, মানিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মেসার্স রেবা ট্রেডার্সের ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৩ টাকা। মানিক ব্যাংকে চাকরি করলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে ছাত্র ভর্তি ও নিয়োগ প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়ে অবৈধ টাকা উপার্জন করাই ছিল তাঁর পেশা।
অবশ্য আদালতে মানিকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এমন অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
দুদকের সাবেক কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকা
মফিজুর রহমান ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিদর্শক পদে যোগ দেন। দুদকে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২০১২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় পাবলিক পরীক্ষা অপরাধ আইনে মামলাও হয়। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
অর্থ পাচার আইনে সিআইডির করা মামলায় বলা হয়, ‘মফিজুর রহমান ঢাকার ডিআইটি প্রজেক্ট মেরুল বাড্ডায় স্ত্রী ও শ্যালকের নামে দুই কাঠার বেশি জমি কেনেন। স্ত্রীর যাতায়াতের জন্য একটি গাড়িও কেনেন। তবে গাড়িটি নিবন্ধন করেন ভায়রার নামে।’
মফিজুরের দুটি ব্যাংক হিসাব এবং তাঁর স্ত্রীর একটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। মামলায় বলা হয়, মফিজুর ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০১ টাকা জমা হয়। ওই ব্যাংক হিসাব থেকে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার ৫২২ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক হিসাবে জমা আছে মাত্র ৪ লাখ ২০ হাজার ৯৭৯ টাকা।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, মফিজুরের স্ত্রী ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষিকা। স্ত্রীর নামে শান্তিনগর ডাকঘর শাখায় পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। নিউমার্কেট ডাকঘরে ৫ লাখ, ইসলামী ব্যাংকের রামপুরা শাখায় ১০ লাখ টাকা রয়েছে। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জে অগ্রণী ব্যাংকে মফিজুরের স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকা জমার তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
মফিজুর রহমানও আদালতের কাছে দাবি করেন, তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।
রাকিবুলের ব্যাংক হিসাবে অর্ধকোটি টাকা
রকিবুল হাসান জনতা ব্যাংকে গত বছর শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বরখাস্ত। তাঁর তিনটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। মামলায় বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাকিবুলের ব্যাংক হিসাবে ২৮ লাখ ১০ হাজার ৯৪৯ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ওই ব্যাংক হিসাব থেকে ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৫৩৬ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রকিবুল হাসানের ডাচ–বাংলা ব্যাংকের হিসাবে পাওয়া গেছে ২৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪১৬ টাকা। এর বাইরে জনতা ব্যাংক মতিঝিল শাখায় রাকিবুলের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হয় ২ লাখ ১১ হাজার ৫৩২ টাকা।
ডায়েরিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার মানিক কুমার প্রামাণিকের চারটি ডায়েরি জব্দ করা হয়। সিআইডি বলছে, মানিকের ডায়েরির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ‘অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তিসহ বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ পাইয়ে দিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
মানিক নিজ হাতে ডায়েরিতে অবৈধভাবে ভর্তি করানো প্রার্থীর কাছ থেকে যে টাকা নিতেন, তার হিসাব রাখতেন। সেখানে অন্য চক্রের সদস্যদের নাম ও তথ্য পাওয়া গেছে।
যেভাবে এল এই তিনজনের নাম
তিন বছর আগের তেজগাঁও থানার একটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে উঠে আসে মানিক, মফিজুর ও রকিবুলদের নাম। পরে তাঁদের সেই মামলায়ও আসামি করা হয়। গত বছর এই তিনজন গ্রেপ্তার হলে রাকিবুল ২০১৮ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। পাশাপাশি মানিক ও মফিজুর জড়িত বলেও জানান।
২০১৮ সালের মামলায় অভিযোগ করা হয়, পরীক্ষা চলার সময় চক্রটি প্রশ্ন ডিজিটাল ডিভাইসের সহায়তায় কেন্দ্র থেকে বাইরে নিয়ে আসেন। তখন প্রশ্নপত্র সমাধানে যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের দিয়ে প্রশ্নগুলো সমাধান করা হয়। পরে তা ডিজিটাল ডিভাইসের সহায়তায় আবার পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দেন চক্রের সদস্যরা।