ধর্ষণ মামলায় বিচারকের পর্যবেক্ষণ অসম্মানজনক, ৮০ নাগরিকের বিবৃতি

ধর্ষণ মামলায় বিচারকের পর্যবেক্ষণ অসম্মানজনক, ৮০ নাগরিকের বিবৃতি

রাজধানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৮০ নাগরিক।

রবিবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘নারীর প্রতি চলমান সহিংসতার বিচার নিশ্চিত করা যেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ সংবেদনশীল হওয়া কাম্য। বিদ্যমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেওয়ারই সুযোগ পান না এবং মামলা হলেও নারী নির্যাতনের মামলায় অপরাধীর সাজা প্রায় হয় না বললেই চলে।’

সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এ রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে। রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাতসহ পাঁচ আসামিকেই খালাস দেওয়া হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, মামলার বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেছেন যা তার এখতিয়ারবহির্ভূত এবং নারীর সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা এ পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এ মামলার শুরু থেকেই অত্যন্ত প্রভাবশালী আসামিদের পক্ষ থেকে প্রচুর চাপ এবং ভুক্তভোগীদের ‘ভিকটিম ব্লেমিং’সহ নানানভাবে হয়রানির বিষয় মিডিয়াতে এসেছে। আসামিদের আস্ফালন সে সময় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিতও হয়েছে। সেই আসামিদের ক্ষমতার দম্ভই আজ রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

রায়ে ভুক্তভোগীদের আগের যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে তারা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নন বলে বিচারকের পর্যবেক্ষণ ভিকটিম ব্লেমিংয়ের শামিল, যা হাইকোর্টের নির্দেশনার সরাসরি ব্যত্যয়। আর সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য। আদালতের এ পর্যবেক্ষণের ফলে জনমনে ভুল ধারণা হতে পারে যে, আগে যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থাকা কোনো নারী ধর্ষণের বিচার আশা করতে পারেন না। এর ফলে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়বে এবং বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়বে বলে আমরা মনে করি।

তারা মনে করেন, আদালত নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো অপরাধকে স্বাভাবিকীকরণ করেছেন এবং জনমনে এই বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন যে, ধর্ষণের জন্য নারী নিজেই দায়ী। বাংলাদেশে নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং যৎকিঞ্চিৎ অগ্রগতি হয়েছে এমন পর্যবেক্ষণ তাকে পেছনে ঠেলে দেবে। এ রায় নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়াবে বলে আমরা মনে করি। ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা করার বাধ্যবাধকতা তৈরি করা বা ডাক্তারি প্রত্যয়নপত্র ছাড়া ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার এই ট্রাইব্যুনালের নেই। ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা নয়, বরং ৭২ বছর পরও মামলা করতে পারার অধিকার ভুক্তভোগীদের আছে। অথচ তার এই পরামর্শের কারণে যাদের ধর্ষণ করা হয়েছে, তাদের নিরাপত্তা আরও বেশি সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে, যার দায় উল্লিখিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকের। এ ছাড়া মামলা তদন্ত করে আসামির অপরাধ প্রমাণ করা যেমন রাষ্ট্রপক্ষের কাজ, তেমনি যে কোনো মামলার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আদালতের কাজ। একটি মামলা করে আদালতের সময় নষ্ট করার অভিযোগ তোলা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত ব্যক্তির কাজের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা না থাকার উদাহরণ।

উল্লিখিত মামলার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী আসামিপক্ষের খালাস পাওয়ার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষের মামলার জন্য যথাযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন না করতে পারার দায় বাদীদের হতে পারে না। অথচ সব দোষ দুই ভুক্তভোগীর ওপর চাপানো হয়েছে। উপরন্তু, ভুক্তভোগীদের চরিত্র সম্পর্কে বিচারকের মতামত অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং যে কোনো নাগরিকের জন্য অসম্মানজনক। এ ছাড়া দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মামলাকে প্রভাবিত করেছেন বলে বিচারকের মন্তব্য জনমনে প্রশ্ন তোলে- বাংলাদেশের সমাজ সম্পর্কে তার বাস্তব জ্ঞান সম্বন্ধে। কারণ এ সমাজে ভুক্তভোগী নারীরাই প্রান্তিক এবং নিপীড়নের শিকার। উল্টোটা নয়।

দেশের আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নাগরিকবৃন্দ তিন দফা দাবিও জানান।

বিবৃতিদাতারা হলেন- ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য মেঘনা গুহঠাকুরতা, নারী আন্দোলনকর্মী শিরীন হক, নারী আন্দোলন অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক অধ্যাপক মালেকা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মানবাধিকার কর্মী শাহীন আনাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. নাসরিন খন্দকার, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের প্রফেসরিয়াল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট স্বপন আদনান, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার ফরিদা আখতার প্রমুখ।