গ্রাহকের ৩,০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে দিয়েছে পেট্রোবাংলা

গ্রাহকের ৩,০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে দিয়েছে পেট্রোবাংলা

গ্রাহকের পরিশোধ করা গ্যাসের দামের একটি অংশ জমা হয় গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে এ তহবিলের টাকা খরচ করার কথা। কিন্তু নিজেদের আয়ের উদ্বৃত্ত হিসেবে এ তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এটি ফেরত দিতে এ পর্যন্ত চার দফায় পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সর্বশেষ গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে পেট্রোবাংলাকে একটি চিঠি দিয়েছে বিইআরসি।

এতে বলা হয়, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের তিন হাজার কোটি টাকা সুদসহ ফেরত দিতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে নেওয়া ব্যবস্থার বিষয়ে কমিশন অবহিত নয়। দ্রুত টাকা ফেরত দিয়ে তার প্রমাণসহ কমিশনকে অবহিত করতে চিঠিতে অনুরোধ করে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বিইআরসির দুজন কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ চিঠির বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি পেট্রোবাংলা। টাকা ফেরত না দিলে বিইআরসিও গ্রাহকের মামলার মুখে পড়তে পারে। কমিশনের আদেশে গ্রাহক তহবিলের টাকার আলাদা হিসাব রাখতে বলা হয়েছে পেট্রোবাংলাকে। তাহলে আর এ ধরনের ভুল করার আশঙ্কা থাকবে না। পেট্রোবাংলাকে প্রথম চিঠি দেওয়া হয় গত বছরের ১১ অক্টোবর। এরপর পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও তা নাকচ করে ৫ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি আবার চিঠি পাঠায় বিইআরসি। টাকা ফেরতের তাগাদা দেওয়া হয় এসব চিঠিতে।

বিইআরসির সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ আবু ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এটা ভোক্তাদের টাকা। কোনোভাবেই এটি পেট্রোবাংলার উদ্বৃত্ত আয় হতে পারে না। তাই এটি ফেরত দিতে পেট্রোবাংলাকে বারবার চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ এতে সম্মত হয়েছে। ‘শিগগিরই’ এটি তহবিলে ফেরত আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এর আগে বিইআরসির চিঠির জবাবে পেট্রোবাংলা জানায়, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের হিসাবে থাকা উদ্বৃত্ত আয়ের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে গত বছর একটি আইন করে অর্থ বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল আলাদা না করে সব আয় একসঙ্গে মিলিয়ে হিসাব করে পেট্রোবাংলা। এরপর গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা থাকা ৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়।

এর উত্তরে পেট্রোবাংলাকে বিইআরসি জানায়, পেট্রোবাংলার বক্তব্য সঠিক নয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার নিজস্ব তহবিলে উদ্বৃত্ত ৪ হাজার কোটি টাকা ও পেট্রোবাংলার তহবিলে তিতাস গ্যাস কোম্পানির শেয়ার বিক্রি বাবদ জমা ১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকাসহ মোট ৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলেছে অর্থ বিভাগ। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কোনো নির্দেশনা অর্থ বিভাগের চিঠিতে দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস বিক্রি থেকেই নিয়মিত আয় করে পেট্রোবাংলা। তাই তাদের আয়ের সব হিসাব থেকেই উদ্বৃত্ত হিসেবে অর্থ বিভাগ টাকা নিয়েছে। এটি পেট্রোবাংলা ‘ভুল’ করে দিয়ে দিয়েছে। অর্থ বিভাগকে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে, গ্রাহকের টাকা নেওয়া যাবে না।

আনিছুর রহমান বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) জন্য সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকির টাকা পাওনা আছে। অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকির টাকা পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক তহবিলের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

বিইআরসি বলছে, ২০০৯ সালের ৩০ জুলাই গ্যাসের দাম ১১ দশমিক ২২ ভাগ বাড়ানো হয়। ওই সময় আদেশে কমিশন বলেছে, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে অতিরিক্ত অর্থ পেট্রোবাংলার তহবিলে জমা হওয়ার কথা, তার পুরো অর্থ থাকবে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে। এ টাকার সুদও জমা হবে একই তহবিলে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩০ জুন ভোক্তা পর্যায়ে ৩৮ দশমিক ২ ভাগ বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। দামের একটি অংশ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমার আদেশ দেওয়া হয়। প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা তহবিলে জমার নির্দেশ দেয় কমিশন।

বিইআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, ভোক্তাসাধারণের টাকা তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে নিয়োজিত জাতীয় কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠিত হয়েছে। তাই এ তহবিলের মালিক দেশের ভোক্তাসাধারণ। ২০০৯ সালে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আদেশে এ তহবিল গঠন করে বিইআরসি। এ তহবিলের টাকা খরচ করার জন্য ২০১২ সালে তৈরি হয় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নীতিমালা। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ১০ বছরের জন্য জারি করা নীতিমালাটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে আরও ১০ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। গত আগস্ট পর্যন্ত এ তহবিলে ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা জমা আছে বলে জানা গেছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, তহবিল গঠনের পর নীতিমালা তৈরি করতে তিন বছর লেগে যায়। তাই প্রথম তিন বছরে তহবিলের টাকা ব্যবহার করা যায়নি। এরপর এই তহবিলের টাকায় অনেকগুলো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি কোম্পানি গাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খননের জন্যও এ তহবিলের টাকা ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ গ্রাহক তহবিলের টাকা শুধু দেশীয় কোম্পানির প্রকল্পে ব্যবহার করার কথা ছিল।

এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালার বাইরে খরচ করা তহবিল তছরুপের মধ্যে পড়ে। গ্রাহকের তহবিল জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা জবরদখল করেছে। এ তহবিলের টাকা খরচ করে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে আরেক দফা তছরুপ করা হলো। এটি করে নীতিমালা না মানার প্রমাণ দেখিয়েছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ।