যাত্রী-শ্রমিক সবাই নাখোশ

যাত্রী-শ্রমিক সবাই নাখোশ

ভ্রাম্যমাণ আদালতের টানা অভিযান, সরকার ও সমিতির হুঁশিয়ারি, যাত্রীদের প্রতিবাদ- কিছুতেই বন্ধ হয়নি গণপরিবহনের বাড়তি ভাড়া। ভাড়ার জন্য মালিকরা দোষ দিচ্ছেন শ্রমিককে। শ্রমিকরা দিচ্ছেন মালিককে। আবার দু'পক্ষ মিলিতভাবে দায়ী করছে চাঁদাবাজিকে। আর যাত্রীরা বলছেন, দোষ যারই হোক, তাদের পকেট কাটা যাচ্ছে।

পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাসের 'সর্বাঙ্গে ব্যথা'। বিশৃঙ্খলাই এর প্রধান সমস্যা। এ খাত ঠিক করতে হলে সবার আগে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর জিগাতলা, ধানমন্ডি-২৭ ও ফার্মগেট এলাকায় ২৭টি বাসের শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে সমকাল। ফোনে কথা হয় বাস মালিকদের সঙ্গে। এতে পাওয়া যায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। শ্রমিকদের অভিযোগ, মালিকের আয় বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি। বরং সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ায় পরিশ্রম বেড়েছে। 'ওয়েবিল' পদ্ধতির কারণে মজুরির বাইরে আয় নেই। কী করে জীবন চলে?

পল্লবী-সদরঘাট রুটের বিহঙ্গ পরিবহনের চালক মো. তারেক বলেন, দিনে তিনটি ট্রিপ চালিয়ে ৩০০ করে ৯০০ টাকা পান তিনি ও হেলপার। আর খোরাকি বাবদ পান ১০০ টাকা। আগে বাসে দৈনিক ডিজেল লাগত তিন হাজার টাকার। এখন লাগে চার হাজার টাকার। আগে দৈনিক ভাড়া আসত ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। এখন আসে আট থেকে ৯ হাজার টাকা। মালিকের এক হাজার টাকা ডিজেল খরচ বেড়ে দুই হাজার টাকা আয় বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকের এক টাকাও মজুরি বাড়েনি।

তবে মালিকদের দাবি, ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ তথা কিলোমিটারে ৪৫ পয়সা বাড়লেও মুনাফা নেই। ব্যাংকের কিস্তি শোধ করা দুস্কর হয়েছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, বাড়তি ভাড়া নিলে মালিকের কী লাভ? মালিক তো টাকা পান কিলোমিটারে দুই টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে সিট গুনে। চালক-শ্রমিকরা বাড়তি ভাড়া নেয়।

অন্যদিকে, সব যাত্রীর কাছ থেকেই অভিযোগ পাওয়া গেছে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার। তারা বলছেন, ভাড়া যেখানে পাঁচ টাকা বেড়েছে, সেখানে ১০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরেও ভাড়ার বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। অধিকাংশ বাসেই ভাড়ার তালিকা নেই। দু-একটিতে থাকলেও তা এমন স্থানে লাগানো যে সহজে যাত্রীদের চোখে পড়বে না।

ফার্মগেট থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের দূরত্ব ১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবে ভাড়া ৩৮ টাকা। স্বাধীন পরিবহনের বাসে নেওয়া হয় ৪৫ টাকা। ৭ টাকা কেন বাড়তি নেওয়া হচ্ছে- এ প্রশ্নে চালকের সহকারী রাসেল মিয়া বললেন, মালিক ভাড়া নেন সিট গুনে। সকাল ও বিকেল বাদে বাকি সময় বাস খালি চলে। এজন্য বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন।
চিটাগং রোড-চন্দ্রা রুটের ঠিকানা পরিবহনে ধানমন্ডি-২৭ থেকে গাবতলীর ভাড়া চাওয়া হয় ২০ টাকা। যদিও এ পথে নতুন ভাড়া আসে ১২ টাকা। কোন যুক্তিতে ২০ টাকা চাওয়া হচ্ছে- তার জবাবে বাসের হেলপার বললেন, ভাড়ার তালিকায় ধানমন্ডি-২৭ নম্বরে স্টপেজ নেই। স্টপেজ সায়েন্স ল্যাব। তাই ২০ টাকা দিতে হবে। যদিও তালিকা অনুযায়ী গাবতলী-সায়েন্স ল্যাবের ভাড়া ১৪ টাকা। এ হিসাবে ছয় টাকা বেশি। এরপর আর হেলপারের জবাব নেই। বললেন, 'মালিকের হুকুম'। সরদঘাট-চন্দ্রা রুটের সাভার পরিবহন ও ধানমন্ডি-২৭ থেকে গাবতলীর ভাড়া ২০ টাকা চাওয়া হয়। এ বাসের হেলপারেরও দাবি, 'মালিকের নির্দেশ'।

পরিসংখ্যানও দিচ্ছে বাড়তি ভাড়ার সাক্ষ্য। গত মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত ৩৪২টি বাসে অভিযান চালিয়ে বাড়তি ভাড়া নেওয়ায় ১০৪টিকে জরিমানা করেন। পরদিন বুধবার ২৫৬টি বাসে অভিযান চালিয়ে ৬০টিকে জরিমানা করা হয়। গতকাল ২৬৬ বাসের ৬৯টিকে জরিমানা করা হয়েছে। বাড়তি ভাড়া নিয়ে সাজা পাওয়ার পরও আবার একই কাজ করায় গত তিন দিনে পাঁচটি বাসকে ডাম্পিং করা হয়েছে।

বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলম বলেন, অভিযানের সুফল মিলছে। বাড়তি ভাড়া নেওয়া বাসের সংখ্যা কমছে।

বাড়তি ভাড়া নিলে শুধু চালক নয়, মালিকদেরও জরিমানা করার কথা। কিন্তু তা কেন করা হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে সরওয়ার আলম বলেন, 'এ বিষয়ে এখনও সরকারের নির্দেশনা নেই।'

গতকাল জিগাতলায় কথা হয় 'তরঙ্গ প্লাস' পরিবহনের যাত্রী রাজিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, জিগাতলা থেকে বনশ্রী ৪৫ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। আগে ছিল ৩৫ টাকা। বাসে ২৫ দিন কর্মদিবস হিসেবে তার খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকা। আয় তো বাড়েনি, বাড়তি খরচ কী করে জোগাড় করবেন?

গতকালও শ্রমিকরা বলেছেন, যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে চান না। তালিকার চেয়েও কম দিতে চান। এ নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা লেগেই রয়েছে। যাত্রীরা একজোট হয়ে শ্রমিকদের মারধর করছে। তবে যাত্রীরা বলছেন, বাড়তি ভাড়ার জন্য শ্রমিকরা বরং লাঞ্ছিত করছে। বচসা বন্ধে শ্রমিকরা আবার বেশি ভাড়ার সিটিং সার্ভিস চায়।

'ওয়েবিল' পদ্ধতিতে মালিকের পক্ষে চেকার স্টপেজে স্টপেজে বাসে উঠে যাত্রী গুনে লিখে দেন। সে অনুযায়ী চালক-হেলপারের কাছ থেকে ভাড়ার টাকা নেন মালিক। মালিকরা বলছেন, ওয়েবিল তুলে দিলে মালিক টাকা পাবেন না। শ্রমিক নিজের ইচ্ছামতো যাত্রী তুলে বলবে, যাত্রী হয়নি।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সিটিং থাকবে না। স্টপেজ ধরে ওয়েবিল থাকবে। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নতুন ভাড়া পুরোপুরি কার্যকরের পর শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হবে।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ঢাকায় বাসের ব্যবসা লাভজনক নয় বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের কারণে। পাঁচ বছর আগে সাত হাজার বাস চলত। এখন চলছে ছয় হাজারের মতো। বাকি বাসগুলো গেল কোথায়?

তিনি বলেন, শ্রমিকরা ভালো নেই। তারা অমানবিক পরিবেশে কাজ করে মজুরি খুব বেশি পান না। যাত্রীও ভালো নেই। পুরো ব্যবস্থা সমস্যায় জর্জরিত।

গতকাল ফার্মগেট থেকে 'স্পেশাল সার্ভিস' পরিবহনের বাসে গুলিস্তানের ভাড়া চাওয়া হয় ১৫ টাকা। এ পথের নতুন ভাড়া ১০ টাকা। পেছনে থাকা বিআরটিসির বাস ১০ টাকায় গুলিস্তানে যাত্রী নিচ্ছে। স্পেশাল সার্ভিসের ঢাকা-মেট্রো-ব-১৩-০৩৪৩ বাসের চালক ও হেলপার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি বাস বিআরটিসিকে চাঁদা দিতে হয় না। কিন্তু স্পেশাল সার্ভিসের মতো বেসরকারি বাসকে দিনে হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।

চাঁদাবাজির বিষয়ে মালিক-শ্রমিকদের বক্তব্য অভিন্ন। তাদের হিসাবে, চাঁদা না থাকলে কিলোমিটারে ২৫-৩০ পয়সা ভাড়া কম হতো। কিন্তু মালিক ও শ্রমিক সমিতির শীর্ষ নেতারা 'পরিস্থিতিকে যা তা বললেও' চাঁদাবাজি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিতে নারাজ। যদিও তারা গত তিন মাসে তিনবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি নিয়ে।

মালিকদের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার বাসকে দিনে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন সমিতিকে, যা সরকার অনুমোদিত। এর বাইরে ৩০০ টাকা 'জিপি' দিতে হয়। এর মধ্যে ১০০ টাকা বাসটি যে কোম্পানির ব্যানারে চলে তারা পায়। বাকি ২০০ টাকা যায় পথে নির্বিঘ্নে চলার 'খরচ' বাবদ। এই চারশ টাকার বাইরে হাজার টাকা অদৃশ্য চাঁদা রয়েছে।

মালিকদের অভিযোগ, সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানা বাড়ার পর মামলার ভয় দেখিয়ে এসব চাঁদা নেয় পুলিশ। তবে এ অভিযোগের সত্যতা সমকাল যাচাই করে দেখতে পারেনি।

শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবি: সিএনজিতে চলে মোহাম্মদপুর থেকে আজিমপুর রুটের ৩৬ নম্বর বাস। সিএনজিচালিত বাসে ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু এ বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ডিজেলচালিত বাসের মতো ১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যদিও জিগাতলায় পরিবহনটির চেকার আল আমিন 'ওয়েবিলের' খাতা খুলে দেখালেন, ৪১ যাত্রীর ২০ জন ছাত্র। তারা জিগাতলা থেকে আজিমপুরের ভাড়া পাঁচ টাকার বেশি দেবে না। তাই বাকি ২১ যাত্রীর কাছ থেকে আট টাকার ভাড়া ১০ টাকা নিতে হচ্ছে।

১৯৬৯ সালে ছাত্রের ঐতিহাসিক ১১ দফার একটি ছিল বাসে 'হাফ ভাড়া'। আন্দোলনের মাধ্যমে এ দাবি পূরণ হয়েছিল। তবে এখন অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি প্রায় উঠেই গেছে। শিক্ষার্থীরা আবার এ দাবিতে সরব হয়েছেন। গতকাল ঢাকা কলেজের ছাত্ররা মিরপুর সড়ক অবরোধ করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর টাস্কফোর্সের প্রধান। তিনি গতকাল বলেন, ছাত্রদের দাবির বিষয়টি টাস্কফোর্স দেখবে।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, হাফ ভাড়া বলে কিছু আইনে নেই। সরকার ভর্তুকি দিলে মালিকরা অর্ধেক ভাড়া নিতে পারেন। নইলে মালিকের পক্ষে সব খরচের বোঝা বয়ে কম ভাড়া নেওয়া অসম্ভব।