গৌরব-ঐতিহ্যে ১৮১ বছরে ঢাকা কলেজ

গৌরব-ঐতিহ্যে ১৮১ বছরে ঢাকা কলেজ

দেশের সর্বপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা কলেজ। দেশের প্রথম আধুনিক ও সনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি ১৮১ বছরে পদার্পণ করল। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর পথচলা শুরু, গৌরব ও প্রাপ্তির দিক দিয়ে বারবার নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

দীর্ঘ পথচলায় দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সমাজনীতিক- সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে ঢাকা কলেজের গৌরব ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ঢাকা কলেজের নাম৷

ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হলে আমাদের একটু পিছন ফিরে যেতে হয়। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, প্রকৃতপক্ষেই তারা এ অঞ্চলের শাসকে পরিণত হয়।

এরপর দীর্ঘদিন ইংরেজরা এই অঞ্চল শাসন করে গেলেও এখানকার মানুষের জন্য কোনো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেননি। অবশেষে ১৮৩০-এর দশকে সরকার এক শিক্ষানীতি গ্রহণ করে এবং ওই নীতিমালায় যে শিক্ষানীতির প্রচলন হয়, তা মূলত পাশ্চাত্য বা ইংরেজি শিক্ষা নামে পরিচিতি পায়। এরপর থেকে এই অঞ্চলে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠলেও তা শিক্ষা প্রসারের চেয়ে ধর্ম প্রচারে অধিক গুরুত্ব দেয়। যার জন্য এখানে শিক্ষা প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক অবধানের কথা উল্লেখ নেই বললে চলে।

পরবর্তীকালে, ১৮৩৫ সালের ২০ এপ্রিল ওই সময় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন লর্ড বেন্টিকের নিকট একটি প্রতিবেদন পেশ করে, যেখানে বলা হয়, 'সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতোগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।'

এ প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি প্রদান করা হলে ঢাকার ওই সময়ের সিভিল সার্জন ডা: জেমস টেইলার জানান যে এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যে কেবল উচিতই নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকারের সুবিধা 'আর্থিক এবং সামাজিক' পাওয়া যাবে। মূলত তখন থেকেই শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি আলোর দ্যুতি ছড়াতে থাকে অঞ্চলটিতে৷

কিছু দিন পর, শিক্ষা এবং সমাজব্যবস্থার এ ইতিবাচক পরিবর্তনে ওই সময়ের গর্ভনর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন কয়েকটি কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত ব্যয়ের কথা উল্লেখ এবং কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮৪১ সালে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়, যার নাম দেয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলের নাম দেয়া হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল।

কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর পরই বদলে যায় সমগ্র ঢাকার চালচিত্র। ঢাকা হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলার ইংরেজি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। প্রথম ঢাকা কলেজ ভবন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়। তার আগমনের সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে ঢাকা কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত ব্যাবস্থাপনার ভিত্তি। সে অর্থে আয়ারল্যান্ডই ঢাকা কলেজের সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও এর কাঠামোগত পরিবর্তনের গুরুত্ব দেয়া হয়নি তখন।

বিভিন্ন সময়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা হোঁচট খেয়েছে রাজনৈতিক কারণে। সর্বপ্রথম কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা হোঁচট খায় ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়। এসময় শহরে ইউরোপীয় কর্মকর্তা কিংবা ইউরোপপন্থী শিক্ষক ছাত্ররাও এই আন্দোলনে সমর্থন করেন। এই আন্দোলনের মূল স্লোগান ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি। যার ফলে বহুকাল অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয় এই প্রতিষ্ঠানকে।

প্রথম বছরেই (১৮৫৮ সালে) চারজন ছাত্র প্রথমবারের মতো স্নাতক বা বি.এ পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতা পাড়ি দেয়।

প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বুড়িগঙ্গার তীরে । সদরঘাটের স্থপতি কর্নেল গ্যাসর্টিন এর নকশা করেন। খাটি ব্রিটিশ ঢঙে, বিলাতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাস পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর রোড়ে নিউমার্কেটের ঠিক পাশেই স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠানটির।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মাথা উঁচু করে শহরের প্রাণকেন্দ্র দাঁড়িয়ে থেকে এই অঞ্চলের জন্য অবদান রেখে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। জগন্নাথ কলেজ বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে ঢাকা কলেজের ত্যাগ ও আত্মবিসর্জন।

লাখো শিক্ষার্থী বিদায় নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেকে মেলে ধরেছেন সগৌরবে, অবদান রেখেছে দেশের উন্নয়নের কিংবা দেশ পরিচালনা ক্ষেত্রে। ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর নিয়মিত পথচলায় মুখরিত থাকে এই ক্যাম্পাসে।

বর্তমানে ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এবং শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাঙ্গন। এর ছাত্রসংখ্যা প্রায় ২৪,০০০। এখানে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমের সাথে সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১৯টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রয়েছে । ছাত্রদের জন্য ঢাকা কলেজে ৮টি ছাত্রাবাস রয়েছে। এসব ছাত্রাবাসে ছাত্রদের আধুনিক এবং উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করে থাকে। বর্তমানে কলেজটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে।

এমজে/