সুশীল সমাজের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এখন বৈরী: সিপিডি

সুশীল সমাজের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এখন বৈরী: সিপিডি

বিভিন্ন দেশের সুশীল সমাজ গণতান্ত্রিক উত্তরণে সরাসারি অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজও এই প্রবণতায় যুক্ত হবে কি হবে না- তা সময়ই বলে দেবে। এ মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সিপিডি আয়োজিত আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সম্মেলনের এক অধিবেশনে এমন মন্তব্য করেছেন তিনি। তার এই মন্তব্যের পক্ষে সুদানের উদাহরণ টেনে আনেন তিনি। থাইল্যান্ডের সামাজিক আন্দোলনে যুব সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার উদাহরণও দেন ড. দেবপ্রিয়। সম্মেলনের তৃতীয় দিনের সর্বশেষ এ অধিবেশনে আলোচনার বিষয় ছিল- 'সামাজিক পরিবর্তন'। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বীনা আগরওয়াল এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

'বাংলাদেশের সুশীল সমাজ অনুধাবন :বিবর্তন, প্রসঙ্গ ও চ্যালেঞ্জ' বিষয়ক প্রবন্ধে তিনি পর্যায়ক্রমে জাতীয় নির্বাচনে সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ প্রবণতা ব্যাখ্যা করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সুশীল সমাজের মতামত এবং পরামর্শের বিষয়টি ছিল প্রায় প্রকাশ্য। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এই মধুর সম্পর্ক ক্রমেই বৈরী হয়ে ওঠে। সম্পর্কের এ অবনতি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তোলে। এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউস ইনডেপের তথ্য তুলে ড. দেবপ্রিয় বলেন, সংস্থার স্কোর অনুযায়ী, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় বর্তমানের তুলনা করলে রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ ৪২ শতাংশ সীমিত হয়ে এসেছে। সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা কমেছে ২৭ শতাংশ। ভোট প্রক্রিয়া কমেছে ৫৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন এবং সুশীল সমাজের সম্পর্ক প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, আশির দশকের শেষার্ধে এ দু'পক্ষের মধ্যকার তুমুল প্রতিযোগিতা ছিল। গত ২০০০ সালের শেষার্ধে দু'পক্ষের মধ্যে একটা কার্যকর সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখা যায়। ওই সময় দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সহযোগী হিসেবে সরাসরি অংশ নিয়েছে সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজের এ যাবৎ সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন দেবপ্রিয়। এগুলো হলো- মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ তুলে ধরা এবং '৭১-এর দালালদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সহায়তা দেওয়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা, সুরক্ষা ও ভোটাধিকারে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা ও দরিদ্র মানুষের স্বার্থ এবং তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা।

অধিবেশনে মানব উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তন- এ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ড. সেলিম জাহান। তিনি বলেন, মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নকে মিরাকল বলা যায়। গড় আয়ু, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসসহ সব সূচকের দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে সব অর্জন সমহারে হয়নি। তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষ এখনও দরিদ্র। আঞ্চলিক বৈষম্যও প্রকট। করোনা পরিস্থিতি বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য অঞ্চলভিত্তিক সহায়ক নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। তবে এ ক্ষেত্রে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাকে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন তিনি। ড. সেলিম জাহানের প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অপফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ড. সাবিনা আলকাইরি বলেন, মানব উন্নয়নে মূল্যবোধের চর্চা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সহনশীলতা খুব জরুরি। উন্নয়নের সব পর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য এনজিও এবং সুশীল সমাজকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।

এ অধিবেশনে নারী-পুরুষ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো ড. সোহেলা নাজনীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি দ্রুত এবং অসম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো নারী-পুরুষ সমতার দুর্বল ভিত্তিতে এ দেশেও রয়েছে। শ্রমবাজারে নারীর কম অংশগ্রহণ, কাজের স্বীকৃতি না থাকা এবং পারিবারিক সহিংসতার কথা উল্লেখ করেন তিনি। করোনা এ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। ফলে কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও অনেক পথ এখনও যাওয়ার বাকি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।