ঘুসের ওপেন হাট রাজউক: প্রভাবশালীদের পেছনে রাজনীতির শক্ত খুঁটি

ঘুসের ওপেন হাট রাজউক: প্রভাবশালীদের পেছনে রাজনীতির শক্ত খুঁটি

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দেয়ালে দেয়ালে সাবধান বাণী। ‘দুর্নীতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ ‘দুর্নীতি করব না, দুর্নীতি সইব না।’ আরও কত কী নীতিকথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। বাস্তবতা হলো এখানে ঘুসের লেনদেন ছায়াসঙ্গীর মতো।

আরও সহজ করে বললে বলতে হবে-ঘুসের ওপেন হাট। এর ফলে রাজউকে ঘুস ছাড়া ফাইল রিলিজ করা অনেকটা সাঁতার না জেনে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। পরতে পরতে ঘুসের রেট বাঁধা। প্যাকেজ রেটে ঘুস আদায়ের বহু পুরনো পদ্ধতি এখনো চালু।

রাজউকের বিভিন্ন শাখায় ঘুরে অবিশ্বাস্য চিত্র দেখা যায়। সকাল থেকেই এনেক্স ভবনের এস্টেট ও ভূমি-২ শাখার প্রায় সব কর্মকর্তাকে মহাব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কারও যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। সবাই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং সই-স্বাক্ষরে ব্যস্ত। আবার টেবিলে টেবিলে নিচু স্বরে কথাবার্তাও হচ্ছে। পরিবেশ অনেকটা গ্রাম্য হাটের মতো।

পরিচালক (পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প) শেখ শাহিনুল ইসলামের কক্ষের সামনে একটু পরপরই দর্শনার্থী আসছেন। কিন্তু পরিচালক অনুপস্থিত। তিনি মন্ত্রণালয়ে গেছেন মিটিংয়ে। ফলে কক্ষটি বন্ধ। তাকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা।

পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন পাঠানও অনুপস্থিত। ২ ডিসেম্বর থেকে ছুটি নিয়ে তিনি নাকি দুবাই ভ্রমণে আছেন। বিদেশ থেকে তিনি কবে ফিরবেন তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে কেউ জানাতে পারেননি। এ-৪২১ নম্বর কক্ষের ভেতর বসে আছেন ৪-৫ জন সেবাপ্রার্থী। দরজা আধা খোলা।

সামান্য ফাঁক দিয়ে কয়েকজনকে স্পষ্ট টাকা লেনদেন করতে দেখা যায়। একজন বান্ডিল খুলছেন। এ সময় কেউ একজন বুঝতে পেরে ভেতর থেকে দরজা আরেকটু ঠেলে দেন। কিন্তু তার আগেই লেনদেনের স্পষ্ট ভিডিও চিত্র ধরা পড়ে।

পাশের ৪২২ নম্বর কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখা যায়। বাইরে নেপপ্লেটে লেখা কর্মকর্তার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি ডেপুটি ডাইরেক্টর (এস্টেট ও ল্যান্ড-৩)। এছাড়া সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম, উপপরিচালক চলতি দায়িত্ব মুন্না সবনম খন্দকার, সহকারী পরিচালক ফারিয়া সুলতানা, সহকারী পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম, ইলিয়াস মোল্লা এবং উপপরিচালক নায়েব আলী শরীফের কক্ষের সামনে সেবাপ্রার্থীদের জটলা।

সহকারী পরিচালক বিধান রায়ের কক্ষের সামনে দাঁড়াতেই দুজন লোক পরিচয় জানতে চান। তাদের প্রশ্ন-কী কাজে এসেছেন দ্রুত বলে ফেলেন। এখানে অযথা ভিড় করা যাবে না। এ-৪১৫ নম্বর কক্ষে আব্দুস সাত্তার এবং গিয়াস উদ্দিন নামের দুই কানুনগোর বসার ব্যবস্থা। সেখানে সেবাপ্রত্যাশীদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দুজনের কারও সঙ্গে দেখা না পেয়ে হতাশ অনেকে।

রাজউকের এনেক্স ভবনের তৃতীয়তলায় এ-৩০৫ নম্বর কক্ষটি অফিস, না ক্লাব বোঝা মুশকিল। দরজার কাছে দাঁড়াতেই সিগারেটের উৎকট গন্ধ। ঘরময় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। মেঝেতে অসংখ্য সিগারেটের পরিত্যক্ত অংশ। মনে হয় ঝাড়ু পড়েনি বহুদিন।

পাশের এ-৩০৪ নম্বর কক্ষের ভেতর থেকে খানিক পরপর অট্টহাসির শব্দ ভেসে আসছে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, কর্মকর্তার টেবিল ঘিরে ৮-১০ জন বসা। রাজনৈতিক নেতার ভঙ্গিতে তাদের সঙ্গে এক কর্মকর্তা আলাপে মশগুল। বাইরে নামফলকে কর্মকর্তার নাম লেখা-মো. আলামিন, সহকারী পরিচালক (সিভিল), অতিরিক্ত দায়িত্ব, সদর দপ্তর।

রাজউকে সরেজমিন অবস্থানের সময় বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম আসে হাতে। এদের অন্যতম হলেন জনৈক কর্মচারী ওবায়দুল্লাহ। তিনি নাকি শত কোটি টাকার মালিক। ওবায়দুল্লাহ সরকারি চাকরি করেন বলে স্ত্রীকে ব্যবসায়ী সাজিয়েছেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম মোহাম্মদ এন্টারপ্রাইজ। অফিস নিয়েছেন রাজউক ভবনের পেছনে ৬০ এমএনএসএন টাওয়ারের ৮ম তলায়।

মঙ্গলবার সেখানে গেলে ভবনের আশপাশের ব্যবসায়ীরা জানান, ৮০৬ নম্বর কক্ষে ওবায়দুল্লাহার স্ত্রীর মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় আছে। দিনের বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকেন তিনি। তবে বিকাল ৫টায় গেলে কক্ষটি বন্ধ পাওয়া যায়। ওবায়দুল্লাহর ভায়েরা ভাই আব্দুল জলিল রাজউক সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক। গোল্ডেন মনিরের মামলায় দুদকে অনুসন্ধান জালে তিনি আটকা পড়েছেন।

রাজউকের নিম্নমান হিসাব সহকারী ফারুক মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ফাইল গায়েব কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে কিছুদিন বরখাস্ত ছিলেন তিনি। শেফাউল নামে এক যুবক ফারুকের হয়ে রাজউকে অফিস করতেন। ফাইলে ফারুকের সই স্বাক্ষর সবই তিনিই দিতেন। কিন্তু একদিন কয়েকটি ফাইল নিয়ে লাপাত্তা হন শেফাউল। এরপর তার ওপর শাস্তির খড়গ নামে।

তবে সম্পদশালী হিসাবে ফারুকের নামডাক আছে। তার নামে ঢাকায় ৮-১০টি প্লট বা ফ্ল্যাট আছে। ৭০ লাখ টাকায় পূর্বাচলে ৫ কাঠার প্লটও কিনেছেন। কম দামে প্লট কিনে বেশি দামে বিক্রির জন্য টাকা বিনিয়োগ তার অন্যতম নেশা।

এখানে বড় বড় তদবিরের কাজ করেন এমন কয়েকজন ব্যক্তির নাম সবার মুখে মুখে শোনা যায়। এরা হলেন জনৈক সাইফুল ওরফে লাল সাইফুল, সাইফুল (২) এবং দীপক। এছাড়া জনৈক মনির নামে একজন কানাডায় বিশাল বিত্তবৈভব গড়েছেন। নিজে দেশে থাকলেও তার পরিবার ইতোমধ্যে কানাডা প্রবাসী।

কম যান রাহেলা ও নুরুল ইসলাম। তাদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার ও বেপরোয়া ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ প্রবল। তারা রাজউকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও কোনো পাত্তা দিতে চান না। তাদের খুঁটির জোর নাকি অনেক শক্ত। একজন তো সারাক্ষণ বলে বেড়ান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা তার নিকট-আত্মীয়।

ফলে তাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। এ তালিকার অনেকের ঘুস লেনদেনের প্রমাণ ও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের ফিরিস্তি। অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই শেষে যা প্রকাশিত হবে।

মুশকিল আসানের গলি : রাজউক ভবনের পাশের গলিতে সকাল ৯টা বাজতেই লোকজনের আনাগোনা শুরু। আশপাশের ছোট ছোট দোকানগুলোতে বেচাকেনাও জমজমাট। আগন্তুকদের বেশির ভাগই জমির দালাল, হাউজিং ব্যবসার এজেন্ট এবং সাধারণ সেবাপ্রার্থী।

ফাঁকে ফাঁকে রাজউকের ২-৪ জন কর্মচারীও আসছেন। চা অথবা সিগারেট খাওয়ার ফাঁকে ‘সিক্রেট’ আলাপও সেরে নিচ্ছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই টাকা-পয়সা লেনদেনের কথাবার্তা কানে আসে।

গলির শেষ প্রান্তে জাফরান টিএন্ড কফি হাউজের সামনে দাঁড়ানো দুজনের একজন রাজউক কর্মচারী, অপরজন সেবাপ্রার্থী। পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আলাপ শুনে বোঝা গেল বিষয়-ঘুস লেনদেন। সেবাপ্রার্থী তার ৫ তলা ভবনটি এখন নয়তলা করতে চান। কিন্তু রাজউকের অনুমোদন মিলছে না।

আলাপের এক পর্যায়ে কিছু টাকা পকেট থেকে বের করে রাজউক কর্মচারীর হাতে তিনি ধরিয়ে দিলেন। টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ওই কর্মচারী বললেন, সামনের মাসে আরও কিছু দিয়েন। নয়তলা কইরা ফালান। অসুবিধা নাই। অর্থ লেনদেনের এ চিত্র ধারণ করা হয়।

গলির মাঝে মোটরবাইকে বসে এক ব্যক্তি ফোনালাপে উত্তেজিত। কাকে যেন বলছেন, ‘এখনও কাজ করতাছে না। ফোনও ধরে না। ওরে যদি বাইরে পাই তাইলে মাইর‌্যা ফালামু। নগদে দেড় লাখ টাকা খাইয়া ফালাইছে।’

সরেজমিন দেখা যায়, গলিতে যারা চা-সিগারেটের দোকান চালাচ্ছেন তারাও পার্টি ধরছেন। যেমন চাঁদপুরের বাসিন্দা সুমন। তার ছোট কাঠের বক্সে চা-সিগারেটের পাশাপাশি কলা-পাউরুটি ঝুলছে। পরিচয় গোপন করে সুমনের কাছে এ প্রতিবেদক জানতে চান-নকশার একটা কাজ করা দরকার। কিন্তু লোক পাচ্ছি না। কী করা যায় বলেন তো?

সুমন বলেন, সমস্যা নাই। তার হাতে রাজউকের ভালো লোক আছে। তবে কাজ হলে তাকেও কমিশন দিতে হবে। আলমগীর হোসেন পলাশ নামের একজনের মোবাইল নম্বর দিয়ে তিনি বলেন, তাকে ফোন দিয়েন। কাজ হবে ১০০ পার্সেন্ট।

শুধু সুমন একা নয়, এখানকার প্রায় প্রতিটি দোকানের সঙ্গেই রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে এমন ‘হটলাইন’ খোলা আছে। ক্লায়েন্টদের অনেকেই এখানে এসে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ফোন করেন। চায়ের কাপ হাতে চলে ঘুসের দরকষাকষি।

গলিতে অনেকের ফোনালাপ উড়ে আসে কানে। টুকরো শব্দের বেশির ভাগই জমির নামজারি, নকশা অনুমোদন, বিল্ডিংয়ের বর্ধিত অংশ ছাড়করণ কিংবা প্লট পরিবর্তনের তদবির। এছাড়া রাজউকের ঘুস লেনদেন হয় নিকটস্থ আহার বিলাস রেস্তোরাঁয়।

জানা যায়, নথি গায়েবের ঘটনা রাজউকের জন্য বড় ব্যর্থতা, যা অমার্জনীয় অপরাধ। বিশেষ করে পূর্বাচল প্রকল্পের কত ফাইল এ পর্যন্ত গায়েব হয়েছে তার হিসাব মেলানো দুরূহ। এক প্লট একাধিকজনের কাছে বিক্রি করতে গায়েব হয় নথি।

এছাড়া জাল-জালিয়াতি তো আছেই। অথচ রাজউকের নথি ব্যবস্থাপনা এখনো সেই মান্ধাতা আমলের। ভবনের একাধিক ফ্লোরে পুরনো ফাইল বোঝাই আলমারি যেন ভেঙে পড়ছে। বেশির ভাগই ছেঁড়াফাটা নথিতে ঠাসা। উপচে পড়ছে কাগজপত্র। এসব ফাইল কি উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত হচ্ছে তা হয়তো জানে না অনেকেই।

দিনভর রাজউক ভবনের বিভিন্ন শাখায় ঘুরে দেখা যায়, সেবাপ্রত্যাশীদের বেশির ভাগই আসছেন পূর্বাচল-এস্টেট-২, গুলশান এস্টেট-১, উত্তরা এস্টেট, ঝিলমিল ও বাড্ডা এলাকার কাজ নিয়ে। এছাড়া ধানমন্ডি ও কাওরান বাজার এলাকা থেকেও সেবাপ্রার্থী আসছেন বাণিজ্যিক প্লট সংক্রান্ত কাজে। নকশা ও আইন শাখা এবং রাজউক চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ প্রার্থীর ভিড় সামলানো বড় কষ্ট।

এর মধ্যে যারা ভিআইপি তদবির নিয়ে আসছেন তাদের আবার কোনো ঝামেলা নেই। ভাবখানা এমন যে, ‘তিনি এলেন, বসলেন এবং তারপর হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন।’ কিন্তু এখানে সাধারণ লোকের হয়রানি হেনস্তা পদে পদে। খাঁটি মক্কেল ধরে লেনদেনের প্রথম পর্ব সারতে না পারলে শুধু হাঁটাহাঁটি করে জুতা ক্ষয় ছাড়া আর কিছু হবে না।

জানা যায়, রাজউকে ঘুস বাণিজ্য হয় প্যাকেজ আকারে। অর্থাৎ ভবন নির্মাণের আগে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র থেকে শুরু করে নকশা পাশ পর্যন্ত সব কাজের জন্য ঘুসের থোক বরাদ্দ দিতে হয়। কোনো একজন কর্মকর্তার কাছে ঘুসের পুরো টাকা তুলে দিতে পারলেই বাজিমাত। সব কাজ হয়ে যায় বিদ্যুৎ গতিতে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্যাকেজে সব কর্মকর্তার ঘুস থাকে। এমনকি যে পিওন ফাইল টেনে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নিয়ে যায় তারও ভাগ থাকে। কাউকে বঞ্চিত করা হয় না। কিন্তু ঘুস না পেলে ফাইল নড়ে না। তখন নানা আইনের মারপ্যাঁচ আসে। ফাইল ঝুলে থাকে বছরের পর বছর।’

তিনি এও বলেন, ‘এখানে চেহারা ও চালচলন দেখে ঘুসখোর চেনা যাবে না। বড় ঘুসখোরদের আচরণ অনেকটা শেয়াল পণ্ডিতের মতো। ওপরে তারা শতভাগ সৎ। কিন্তু দিনশেষে তাদের বড় ভাগটা ঠিকই জায়গামতো পৌঁছে যায়। আবার অনেকে আছেন ড্রয়ারে ঘুসের বড় বান্ডিল রেখে যথারীতি ধর্মচর্চাও করছেন। কিন্তু তাদের সহজে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কিছু। কারণ-তারাই এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত সব বড় বড় সাধু।-যুগান্তর