বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে নতুন বিতর্ক

বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে নতুন বিতর্ক

বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। নিম্নমানের কাগজে এই বই ছাপানোর অভিযোগ সামনে এনেছে একটি পক্ষ। ইস্যুটি নিয়ে দু-একদিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করছে তারা। তবে সরকারকে বিপাকে ফেলতে এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে বলে দাবি করছে আরেকপক্ষ। এ নিয়ে পালটাপালটি অভিযোগ এখন তুঙ্গে। যদিও জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, যে প্রক্রিয়ায় কাজ হয়েছে তাতে নির্ধারিত মানের বাইরে বই মুদ্রণ ও সরবরাহ সম্ভব নয়।

এদিকে সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষাবর্ষ শুরুর পর ইতোমধ্যে ৫ সপ্তাহ পার হয়েছে। কিন্তু এখনো প্রায় অর্ধকোটি বই সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের বই বেশি। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বইও আছে। সংশ্লিষ্ট মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আগেভাগে ‘পিডিআই’ রিপোর্ট (বই সরবরাহের প্রাক-পরিদর্শন প্রতিবেদন) নিয়ে গেছে এনসিটিবি থেকে। যে কারণে কাগজে-কলমে বই সরবরাহ হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এই দুই বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, পাঠ্যবই মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় একাধিকবার পরিদর্শন হয়। এর মধ্যে প্রথমেই আছে মুদ্রণকাজ শুরুর জন্য কাগজ নিরীক্ষা। এরপর বই সরবরাহের আগে একবার নিরীক্ষা হয়। সবশেষে মাঠপর্যায় থেকে ‘সরবরাহ-পরবর্তী’ (পোস্ট-ল্যান্ডিং) প্রতিবেদন আসে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য আলাদা দুটি স্বাধীন সংস্থা পরিদর্শন ও যাচাই কাজ করেছে। এই প্রক্রিয়ায় নিম্নমানের বই মুদ্রণ ও সরবরাহ সম্ভব নয়। তার পরও অভিযোগ খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে। পাশাপাশি মুদ্রিত বইয়ের ব্যাপারে ‘ওয়ারেন্টি’ আছে। জামানতের টাকার একটি নির্দিষ্ট অংশ আটকে রাখা হয়। তাই নিম্নমানের প্রমাণিত হলে বই নতুন করে ছাপানোর পাশাপাশি শাস্তি দেওয়ার সুযোগ আছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিডিআই অনুযায়ী সব বই ছাপানো হয়ে গেছে। মাধ্যমিকের কোনো বই সরবরাহ বাকি নেই। কেবল প্রাথমিকে তিন লাখ বই একটি প্রতিষ্ঠান দিতে পারেনি। ওই প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করাসহ অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সরকার এবার প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৫ কোটি বই মুদ্রণের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে ১ জানুয়ারি সাড়ে তিন কোটি মুদ্রণ বাকি রেখেই শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, এই সংকটের পেছনে যেসব কারণ আছে তার মধ্যে রয়েছে-এনসিটিবি মুদ্রণকাজ শুরুতে বিলম্ব করেছিল। করোনা পরিস্থিতির কারণে এই বিলম্ব হলেও পরে সংস্থাটি সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে। যে কারণে বিভিন্ন স্তরের দরপত্র একাধিকবার ডাকতে হয়েছে। ফলে মুদ্রণকাজ শুরুতে বিলম্ব হয়। আর এ কারণে মাধ্যমিক স্তরের বই সরবরাহ হয়নি সময়মতো। জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিকের সব বইও এখন পর্যন্ত সরবরাহ হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঠ্যবই নিয়ে সিন্ডিকেটের তৎপরতা বহুদিনের। সিন্ডিকেট ভাঙতে ২০২০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বেশির ভাগ কাজে দরপত্র দাখিল করে অগ্রণী প্রিন্টার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রাক্কলন এবং আগের বছরের চেয়ে তখন দর কম পড়ায় বেশির ভাগ কাজ পেয়ে যায় তারা। ফলে চাপে পড়ে সিন্ডিকেট। এরপর গত বছর সিন্ডিকেটের সদস্যরা এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করে। অন্যদিকে যাতে জিম্মি হতে না হয় সে লক্ষ্যে এনসিটিবির একটি অংশ অগ্রণী প্রিন্টার্সকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। সংস্থাটির হস্তক্ষেপে নতুন মেরুকরণ ভেঙে যায় এবং আগের দু’বছরের মতোই অগ্রণী আলাদা দরপত্র দাখিল করে। ফলে পাঠ্যবই সিন্ডিকেটমুক্ত হয়।

এরপর পাঠ্যবই নিয়ে চক্রটি উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, পাঠ্যবই নিয়ে সিন্ডিকেট হয়েছে, তবে সেটা মুদ্রাকর পর্যায়ে নয়। অফিসের লোকজন জড়িত। যে কারণে নিম্নমানের বই সরবরাহ হওয়া সত্ত্বেও ধরেনি। তাই তারা বিভিন্ন উপজেলা থেকে বই সংগ্রহ করে পরীক্ষা করিয়েছেন। ওই পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।

জানা গেছে, এবার প্রাথমিক স্তরের কাজ যেসব প্রতিষ্ঠান পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসসহ আনন্দ, সরকার, প্রমা, কচুয়া, লেটার অ্যান্ড কালারসহ ৩৯টি প্রতিষ্ঠান আছে। তবে সব প্রতিষ্ঠানের বই এমনকি মাধ্যমিকের বইও সংশ্লিষ্টরা রাসায়নিক পরীক্ষা করেনি। ফলে তাদের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বারোতোপা নামে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অনুপ কুমার দে এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি সিন্ডিকেট এনসিটিবিকে জিম্মি করে বেশি দরে বই ছাপাত। সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে এবার আমরা আলাদা দরপত্র দাখিল করি। এতে প্রাথমিক স্তরের মতো মাধ্যমিকেও সরকারের প্রচুর অর্থের সাশ্রয় হয়। কিন্তু সমিতির চিহ্নিত কয়েক নেতা উঠেপড়ে লেগেছে।

অগ্রণী প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী কাওসারুজ্জামান বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রে কাজ পাওয়ার পরও কয়েকজন উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় রিট দাখিলকারীরা হেরে যান। পাশাপাশি জরিমানারও শিকার হন। এখন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।