সাগর-রুনি হত্যার ১০ বছর

ছোট হচ্ছে 'মেঘের আকাশ' তদন্ত এখনও অন্ধকারে

ছোট হচ্ছে 'মেঘের আকাশ' তদন্ত এখনও অন্ধকারে

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে মেঘ তার মা-বাবাকে হারিয়েছিল। ছোট্ট কচি মনে পিতৃ-মাতৃ স্নেহের অভাব ভোলাতে তার নানি নুরুণ নাহার মির্জা ভরসা হয়ে ওঠেন শিশুটির।

সাগর-রুনির খুনি কারা এটা শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারলেন না মেঘের নানি। দেখা হলো না সদ্য কৈশোরে পা রাখা নাতির ঘুরে দাঁড়ানো ভবিষ্যৎ। আর হত্যা মামলার বিচার তো বহু দূরের পথ। মা-বাবার পর নানিকে হারিয়ে মেঘও একাকি হয়েছে। যেন ছোট্ট হয়ে এলো 'মেঘের আকাশ'।

গত ৫ জানুয়ারি মেঘের প্রিয় নানি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। শুধু কি তাই, গত বছরের জুনে মেঘ হারিয়েছে তার আরেক প্রিয় মানুষকে। তিনি হলেন তার খালা নাবিলা ইফাত ধ্রুব। স্বজনরা জানান, মা-বাবার পর এই দুটি মানুষের ভালোবাসার বিশাল জায়গাজুড়ে ছিল মেঘ।

কাল সাগর-রুনি হত্যার এক দশক পূর্ণ হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে আবার আলোচনায় চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনি নিজ ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পর দিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

সাগর-রুনি হত্যাকাে র পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, 'তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।' ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়- 'মোটিভ' নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেকে দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটনের আশ্বাস দেন। তবে কেটে গেছে ১০ বছর। এক দশকেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদন দাখিলে বারবার সময় নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৮৫ বার আদালত থেকে সময় নেওয়া হয়েছে।

গতকাল রুনির ভাই ও মামলার বাদী নওশের আলম সমকালকে বলেন, তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে নতুন কোনো খবর জানা নেই। মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে হারানোর কষ্টে ভুগে মাও চলে গেলেন। মেয়ের মৃত্যুর পর মা ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। আবার মেঘের নির্ভরতার একটি জায়গা ছিল মা। অসুস্থ হয়ে মা যদি বেঁচে থাকতেন, তবু মনে হতো মাথার ওপর ছায়া আছে। সেটা সরে গেল। আমরা অভিভাবক হারালাম। খুনিদের চেহারাও দেখে যেতে পারলেন না, আবার মেঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটাও তার দেখা হলো না।

নওশের আলম আরও বলেন, নানুকে হারানোর আগে গত বছরের জুনে খালা নাবিলা ইফাত ধ্রুবকে হারায় মেঘ। তিনি মেঘকে খুব ভালোবাসতেন। ঢাকায় একই এলাকায় বাসা হওয়ায় প্রায়ই মেঘ ওই বাসায় চলে যেত। খালা মারা যাওয়ার পর কয়েকবার মেঘ আজিমপুর কবরস্থানে ছুটে গেছে। একই জায়গায় ওর মা-বাবা, নানি ও খালা ঘুমিয়ে আছেন। মেঘের বয়স সাড়ে ১৫ বছর। রাজধানীর একটি স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড ৯-এ পড়ছে। ওকে ঠিকঠাক মানুষ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির সমকালকে বলেন, মরার আগে খুনিদের চেহারা দেখব কিনা জানি না। আমি তো এখনও বিচার চাই। আমৃত্যু বিচার চেয়ে যাব। বয়স হয়ে গেছে। শরীরে নানা রোগশোক বাসা বেঁধেছে। এখনও প্রতীক্ষায় আছি বিচার হবে। লোহার সিন্দুক থেকে সব কিছু আলোতে আসবে। তদন্ত কর্মকর্তাও কয়েকদিন আগে ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন। আশা হারাচ্ছি না। তবে দ্রুত প্রতীক্ষার অবসান হোক।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল কে এম আজাদ সমকালকে বলেন, সব মামলার তদন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয় না। তবে র‌্যাব আন্তরিকতা ও গুরুত্ব সহকারে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, এই মামলাটি দীর্ঘদিন হয়ে গেছে। কোনো সুরাহা হয়নি। অলৌকিকভাবে কোনো তথ্য সামনে না এলে এর রহস্য উদ্ঘাটন করা প্রায় দুরূহ। তবে রহস্যভেদ করা গেলে খুব ভালো।

জানা গেছে, সর্বশেষ চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। তবে ধার্য তারিখে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা। পরে বিচারক ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের নতুন তারিখ নির্ধারণ করে দেন। এ নিয়ে ৮৫ বার পেছাল আলোচিত মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন।

২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতির নিহতের ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিনের মাথায় মামলাটি হস্তান্তর করা হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবির কাছে। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় উচ্চ আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ৭৬ দিনের মাথায় ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করা হয় সাগর-রুনির লাশ। লাশের ভিসেরা আলামতসহ আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কারা কী কারণে সাগর-রুনিকে হত্যা করেছে তা এখনও বের করা যায়নি। অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে তদন্ত।

এ মামলার তদন্তের নানা পর্যায়ের দুইশ ব্যক্তির সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকাে ব্যবহূত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ডিএনএ নমুনাও সেখানে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে আলামতের রাসায়নিক ও ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন বাংলাদেশে এলেও সন্দেহাতীতভাবে আসামি শনাক্তে তা খুব একটা কাজে আসেনি। শুরু থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই হত্যার পেছনে নানা সন্দেহের বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেউ কেউ এও বলছিলেন, চুরি করতে গিয়ে বাধা পেয়ে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল। আলামত উদ্ধার করতে না পারায় বিষয়টি নিয়ে আর এগোয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন না, এটি নিছক চুরির ঘটনা।-সমকাল