পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৩ বছর

পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৩ বছর

পিলখানা ট্র্যাজেডির ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে পরিচালিত নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

হত্যা মামলার বিচার ১৩ বছরেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। হাইকোর্টের রায়ের পর মামলাটি এখন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। আসামিপক্ষ বলছে, শুনানির জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আর রাষ্ট্রপক্ষ বলছে এখনও আপিলের পূর্ণাঙ্গ কাজ সম্পন্ন হয়নি। হলেই শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।

২০২০ সালে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর খালাস চেয়ে ২০৩ আসামি আপিল করেছে। আর ৮৩ জনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়েছে।

এখন আপিল শুনানির উদ্যোগ নিলে বিচারের মধ্য দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। আবেদন করার পর সত্যায়িত কপি পাই ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর। রায়টি ৩০ হাজার পৃষ্ঠার, রেডি করতে অনেক সময় লেগেছে। এক সেট রায়ের কপি তুলতে ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা জমা দিতে হয়েছে আমাদের।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী রায়ের কপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী ৯ আসামির পক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ আপিল করেছিলাম ৩০ দিনের মধ্যে। এতে সব মিলিয়ে ১৭ লাখ থেকে ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়। এ আপিলটি ছিল ৬৬ হাজার পৃষ্ঠার।

এত টাকা খরচ করে গরিব আসামিদের পক্ষে আপিল করা সম্ভব নয় মর্মে পরে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করলে সেটি মঞ্জুর হয়। পরে রায়ের কপি ছাড়াই শুধু আবেদন দিয়ে ২০৩ জন আসামির পক্ষে ৪৮টি আপিল করি। এই ২০৩ জনের মধ্যে ৮২ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং অন্যরা যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত।’

আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড থেকে যারা খালাস পেয়েছেন, এবং মৃত্যুদণ্ড থেকে যারা যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যারা নিু আদালতে খালাস পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আপিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, সব আপিল দায়ের সম্পন্ন হলে উভয়পক্ষকে সার সংক্ষেপ জমা দিতে হবে। আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ হলে আসামিপক্ষ থেকে সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া হবে। এরপর আপিল শুনানির জন্য চেম্বার জজ আদালত হয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে যাবে। প্রধান বিচারপতি একটা বেঞ্চ গঠন করে দেবেন। সেখানেই হবে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি।

এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। এদের কয়েকজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১৬১ জনকে।

সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদ সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ আসামি। সাজা হয় ৫৬৮ জনের। এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা জেল আপিল ও আপিল করেন। ৬৯ জন খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসবের ওপর ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। শেষ হয় ৩৭০তম দিনে ১৩ এপ্রিল।

খালাসপ্রাপ্ত ৭৫ জনসহ ৮৩ আসামির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল : হাইকোর্টে খালাস পাওয়া ৭৫ জন এবং সাজা কমে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৮ আসামি মিলিয়ে ৮৩ জনের ক্ষেত্রে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর হাইকোর্টে খালাস পাওয়া চারজনের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর অপর ৭৯ জনের ক্ষেত্রে ২২ ডিসেম্বর পৃথক ১৯টি লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, সব আপিল দায়ের সম্পন্ন হলে উভয়পক্ষকে সার সংক্ষেপ জমা দিতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে লিভ টু আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বিস্ফোরক আইনের মামলাটি এখনও বিচারাধীন : হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাহিনীর নিজস্ব আইনের পাশাপাশি ফৌজদারি আইনে দুটি মামলা হয়। ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে এ দুটি মামলা হয়। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি এখন সাক্ষ্য পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, এ মামলায় ১২৬৪ সাক্ষী রয়েছেন। এ পর্যন্ত মাত্র ২০০ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যাপারে।

বিজিবির নানা কর্মসূচি : নিহতদের স্মরণে শুক্রবার শাহাদতবার্ষিকী পালন করবে বিজিবি। দিনটি পালনের উদ্দেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শাহাদতবার্ষিকীতে দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী শহিদ ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে পিলখানার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরসহ সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কুরআন, বিজিবির সব মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহিদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সব স্থাপনায় বিজিবি পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবির সব সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করবেন। এছাড়া বিজিবির সব সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে। ২৫ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) বাদ জুমা পিলখানার বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে বিজিবি কেন্দ্রীয় মসজিদে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রিত অতিথি, শহিদ ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয়, পিলখানায় কর্মরত সব অফিসার, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারী স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণপূর্বক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অংশগ্রহণ করবেন।

এমজে/