লোভনীয় অফারে অপহরণ, নির্যাতনে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ

লোভনীয় অফারে অপহরণ, নির্যাতনে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ

সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিস, মাসে বেতন ৫০০ ডলার, আছে প্রতি বছর ছুটি। এমন প্রলোভন দেখিয়ে ইরাকের বিভিন্ন শহরে আকামা তৈরির নামে বাংলাদেশি প্রবাসীদের অপরহণ করা হয়। মুক্তিপণ আদায় করতে চলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। ইরাকে বসে বাংলাদেশি একটি চক্র প্রবাসীদের স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। চক্রটির দেশে থাকা দুই সদস্যকে গ্রেফতারের পর গোয়েন্দা পুলিশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।

ইরাকের বাগদাদ শহরের একটি টর্চার সেলে এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে অপহরণের পর লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে করা হচ্ছে নির্যাতন। পাশাপাশি ধারালো ছুরি গলায় ধরে ভিডিওকলে স্বজনদের দেখানো হচ্ছে নির্যাতনের চিত্র। দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।

যারা অপহরণ করছে তারাও বাংলাদেশি। ইরাকের বিভিন্ন শহরে আছে তাদের বন্দিশালা। দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশিদের ভালো চাকরি ও উচ্চবেতনের আশ্বাস দিয়ে ফাঁদ পাতে চক্রটি। আগ্রহীদের কোম্পানি পরিবর্তনের নামে করা হয় জিম্মি। মুক্তিপণ না পাওয়া পর্যন্ত চলে নির্যাতন।

ভুক্তভোগী এক বাংলাদেশি তাদের প্রলোভনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ওরা (অপহরণকারী) আমাকে বলে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি, মাসে ৫০০ ডলার বেতন, দুই বছর পর পর তিন মাসে ছুটি- এসব শুনার পর আমি রাজি হই। তারপর কাজের কথা বলে নিয়ে এসে আমাকে বন্দি করে আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়।’

এ সময় সঙ্গে থাকা দুই হাজার ডলার, ইরাকি দেড়শ’ দিনার, দুটি ঘড়ি, বোনের জন্য কেনা কিছু জিনিস অপহরণকারীরা নিয়ে যায় বলেও জানান তিনি।

এমন ঘটনা যখন বাড়ছে প্রবাসে, তখন দেশে থাকা স্বজনরা বিষয়গুলোর সমাধান পেতে যোগাযোগ করতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে। এমন বহু অভিযোগ আসেতে দেখে সজাগ হয় প্রশাসন। এরপর রাজধানী ও ফরিদপুরে অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক এই চক্রটির দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে জসিম ফকির একজন জনপ্রতিনিধি আর মাহবুব হোসেন তারই শ্যালক।

পুলিশ জানায়, জসিম ফকিরের ভাই জহিরুলসহ চার সহযোগী থাকে ইরাকে। সেখানকার টর্চারসেলগুলো মূলত তারাই পরিচালনা করেন। কাউকে জিম্মি করার পর দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করেন জসিম ও তার শ্যালক মাহবুব।

গ্রেফতারের পর দেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ইরাকে পাঠানোর পুরো পক্রিয়া জানান জসিম ফকির। তিনি বলেন, ‘ইরাকে আমার ছোট ভাই, সে জানায় বিকাশে টাকা লেনদেন হবে। তখন আমি আমার শ্যালকের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে সেটি পাঠিয়ে দেই। এরপর তারা টাকা পাঠালে আমার শ্যালক টাকা তুলে আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমি সেই টাকা ইরাকে পাঠিয়ে দেই।’

মুক্তিপণের টাকায় জসিম ফকির প্রতি সপ্তাহে নিজ বাড়িতে এবং এলাকায় গানবাজনার আয়োজন করেন। দূর-দূরান্ত থেকে ভাড়া করে আনেন শিল্পী।

পুলিশ বলছে, এখানেই শেষ নয় মানবপাচারের সঙ্গেও জড়িত চক্রটি। ট্যুরিস্ট ভিসায় ভারত, দুবাই, ইরান হয়ে ইরাকে লোক পাঠায় তারা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘হাসপাতাল, বিমানবন্দর, আবাসিক হোটেল এবং স্থাপত্যের বিভিন্ন শাখায় ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায় চক্রটি। বিভিন্ন জিকজ্যাক পথে চক্রগুলো পাচার করে থাকে। এরপর তাদের নিয়ে মরুভূমিতে বা কোন কৃষিজমিতে কাজ দেওয়া হয়।’ কাউকে আবার বেকার ফেলে রাখা হয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

মশিউর রহমান বলেন, ‘অভিযুক্ত জসিম চলতি বছরের জানুয়ারিতে মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি মূলত এই জিম্মির টাকায় নির্বাচিত হয়েছেন। আবার প্রতিনিয়তই এলাকার মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য গান ও যাত্রাপালার আয়োজন করে চলছেন।’ এতে স্থানীয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করার সাহস দেখান না বলেও জানান গোয়ান্দা বিভাগের এই কর্মকর্তা।

এদিকে, বিদেশ যাওয়ার আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে কি না তা যাচাই করার পরামর্শ পুলিশের।