সুন্দরবনে বাঘের শরীরে প্রথমবার বসছে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার

সুন্দরবনে বাঘের শরীরে প্রথমবার বসছে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার

সুন্দরবনের বাঘের শরীরে প্রথমবার বসানো হবে স্যাটেলাইট কলার বা ট্রান্সমিটার। মোবাইল সিমের মতো ছোট ডিভাইস বসবে বাঘের শরীরে। বনে বাঘের সংখ্যা বাড়ানো, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও বনে বাঘের সমবণ্টন এর অন্যতম লক্ষ্য। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাঘ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হবে। বনের যে স্থানে বাঘ নেই বা কম আছে সে স্থানে স্থানান্তরের জন্যও ব্যবহার করা হবে আধুনিক এ প্রযুক্তি।

সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৬ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে দুটি বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট কলারিং স্থাপনে খরচ করা হবে আড়াই কোটি টাকা। বাঘের ইকোলোজিক্যাল ট্রান্সফার প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।

বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থাপন প্রসঙ্গে বন অধিদপ্তর জানায়, বর্তমানে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ আছে। খুলনা রেঞ্জে নীলকমল থেকে গেওয়াখালী পর্যন্ত রয়েছে সাতটি বাঘ। এর মধ্যে পুরুষ বাঘ মাত্র একটি। তবে সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যাপ্ত পুরুষ ও স্ত্রী বাঘ রয়েছে, যা ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের তথ্য থেকে প্রমাণিত। তাই অনতিবিলম্বে সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী বাঘ স্থানান্তর করা প্রয়োজন। যদি খুলনা রেঞ্জে পুরুষ বাঘ স্থানান্তর না করা হয় তাহলে নিকট ভবিষ্যতে খুলনা রেঞ্জ বাঘশূন্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনো কারণে পুরুষ বাঘটি মারা গেলে সেখানে প্রজননের জন্য কোনো সুযোগ অবশিষ্ট থাকবে না। এখানে অন্য জায়গা থেকে বাঘ আসার সম্ভাবনাও নেই। কারণ পূর্ব দিকে শিবসা, মরজাত ও নামুদ সমুদ্র নদী, পশ্চিমে আড়পাঙ্গাশিয়া নদী বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। তাই অনতিবিলম্বে দুটি বাঘ খুলনা রেঞ্জে স্থানান্তর করে স্যাটেলাইট কলারের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থানান্তর প্রসঙ্গে বন অধিদপ্তরের উপ প্রধান বন সংরক্ষক (বন ব্যবস্থাপনা উইং) মো. জাহিদুল কবির বলেন, ‘সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ আছে। এমন অনেক স্থান আছে যেখানে শুধু মেল (পুরুষ) বাঘ রয়েছে কিন্তু ফিমেল (স্ত্রী) বাঘ নেই। সুতরাং, বনের অন্য স্থান থেকে মেল বাঘ স্থানান্তর করা হবে। প্রথমে স্থানান্তর করা হবে এক জোড়া বাঘ। সেই জোড়া বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট কলার বা ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হবে। এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার ছোট একটা সিমের মতো। যা বাঘের শরীরে প্রবেশ করানো হবে। এদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। বাঘ জোড়া যে স্থানে ছেড়ে দেওয়া হলো সেখানে আছে কি না আমরা সব সময় নজরদারি করতে পারবো। কারণ আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানে যদি বাঘ না থাকে তবে বাঘশূন্য হবে সেই এলাকা। এতে বাঘ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থানান্তর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুন্দরবনে সব জায়গায় বাঘের সংখ্যা সমান নয়। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে জেনেটিক ভ্যারিয়েবেলিটি (জিনগত পরিবর্তনশীলতা) থাকা দরকার। যত জেনেটিক ভ্যারিয়েবেলিটি থাকবে ততই বাঘের সংখ্যা বাড়বে। এজন্য এক জোড়া করে বাঘ ট্রান্সফার করবো বিভিন্ন স্থানে। স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানোর অন্যতম কারণ এটি।

স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার স্থানান্তরে বাঘের শরীরে কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে মো. জাহিদুল কবির বলেন, এটা ছোট একটি মোবাইল সিমের মতো। বাঘের শরীরে সামান্য একটু অংশ কেটে প্রবেশ করানো হবে। এতে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।

১১৪টি বাঘের আর্থিক মূল্য
বন অধিদপ্তরের মতো বাঘও সুন্দরবনের পাহারাদার। বাঘ না থাকলে পর্যায়ক্রমে সুন্দরবন জবর দখল হয়ে যেত। মানুষ বাঘের ভয়ে এখনো সুন্দরবনকে টিকিয়ে রেখেছে। তাই ১১৪টি বাঘের মূল্য ঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণে আর্থিকমূল্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতি জোড়া বাঘে প্রায় ৫৮৭ কোটি ৬ লাখ টাকার আর্থিক লাভ হয়। সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনের মোট বাঘের সংখ্যা অনুযায়ী আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে মো. জাহিদুল কবির বলেন, বাঘ সুন্দরবনের পাহারাদার। এর আর্থিক মূল্য ঠিক করা কঠিন। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না। বাঘের ভয়ে মানুষ সুন্দরবনের ক্ষতি করতে ভয় পায়। ভারতের একটা গবেষণায় বাঘের এই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাঘ সংরক্ষণে ব্যয় ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ
৩৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি ৫০ কোটি টাকার নিচে ব্যয় হওয়ায় পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এটা অনুমোদন দিয়েছেন। বন অধিদপ্তর প্রকল্পটি এপ্রিল ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মার্চ মেয়াদে বাস্তবায়ন করবে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য
বাঘ ও অন্যান্য প্রাণী সংরক্ষণ, বাঘশূন্য স্থানে বাঘ স্থানান্তরের মাধ্যমে সুন্দরবনে বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণ, লোকালয় সংলগ্ন সুন্দরবনে নাইলন রশির বেষ্টনী, বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ও সচেতনা বাড়ানোর মাধ্যমে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব কমানো হবে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বাঘ সংরক্ষণে বন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো হবে প্রকল্পের আওতায়।

প্রকল্পের নির্দিষ্ট কার্যাবলী
সুন্দরবনে একবার ক্যামেরা ট্র্যাপিং, ২৫টি নানা ধরনের প্রশিক্ষণ, বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে কম বাঘ সম্পন্ন এলাকায় বাঘ স্থানান্তর, সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে বের হয়ে আসা বাঘের বর্তমান ঘনত্ব প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে ২ দশমিক ৫৫ থেকে আগামী ১০ বছরে ৪ দশমিক ৫০ এ উন্নীতকরণ ও পরিবীক্ষণ। সুন্দরবনের প্রতি বর্গকিলোমিটারে বর্তমানে শিকার প্রাণীর ঘনত্ব ১৭ দশমিক ৮৮ থেকে আগামী ১০ বছরে ২০ থেকে ২৩-এ উন্নীতকরণ। সার্ভে করা হবে সুন্দরবনের খাল। ২৫০টি ভিটিআরটি (ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম) সভা করা হবে।

এছাড়া ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পরিবীক্ষণ করা হবে। সুন্দরবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে কেনা হবে দুটি যন্ত্র।

সুন্দরবনে বাঘ টিকিয়ে রাখতে সঠিক গণনা জরুরি
বাঘ পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর প্রাণী। পৃথিবীতে একশ বছর আগেও প্রায় লক্ষাধিক বাঘ ছিল। বিভিন্ন কারণে বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমায় বর্তমানে বিশ্বের ১৩টি দেশে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ অবশিষ্ট আছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী। বাঘ টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার এর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ, পর্যবেক্ষণ ও আবাসস্থল সংরক্ষণ। দেশে বাঘের সংখ্যা নিরূপণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা কাজ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৭৫ সালে হেন্ডিকস স্থানীয় লোকজন, জেলে, বাওয়ালি, মৌওয়ালি, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে থাকা বন বিভাগের লোকদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গবেষণায় ৩৫০টি বাঘ উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ১৯৮২ সালে গবেষণার মাধ্যমে সুন্দরবনে ৪৫০টি রয়েছে বলে উল্লেখ করে।

এছাড়া কেএম টামাং ১৯৯৩ সালে পাগমার্ক গবেষণার মাধ্যমে ৩৬২টি, বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর ২০০৪ সালে পাগমার্ক গবেষণার মাধ্যমে ৪৪০টি, মনিরুল এইচ খান ২০০৭ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে ২০০টি, অ্যাডায় বার্লো রেডিও কলার স্যাটেলাইট/টেলিমেট্রির মাধ্যমে ২০০৯ সালে ৩৩৫-৫০০টি বাঘ এবং সবশেষ বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর ২০১৫ ও ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে যথাক্রমে ১০৬টি ও ১১৪টি বাঘ আছে বলে ঘোষণা করে।

বাঘ টিকিয়ে রাখতে খাদ্যের যোগান জরুরি
সুন্দরবনে বাঘ টিকিয়ে রাখতে হলে আবাসস্থল সংরক্ষণের পাশাপাশি বাঘের খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন তার শিকার প্রাণীর যথাযথ সংরক্ষণ ও সঠিক সংখ্যা নিরূপণ। শিকার প্রাণী বলতে প্রধানত হরিণ, বন্যশুকর, বানর ইত্যাদিকে বুঝায়। যদিও সুন্দরবনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি খুবই দুরূহ, কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে যথেষ্ট জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের মাধ্যমে এই কাজ সম্পাদন করা সম্ভব।

খাবারের নিশ্চয়তা থাকলে তিনগুণ বাঘ থাকা সম্ভব
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলাজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন। ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবনে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর ও ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১ দশমিক ১ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮শ ৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, বাড়ি, বিল। সুন্দরবনের তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭শ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। খাবারের নিশ্চয়তা ও চোরা শিকার বন্ধ হলে সুন্দরবনে দুই থেকে তিন গুণ বাঘ থাকবে।

বাঘের সংখ্যা বাড়ার বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান। এই বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানের তিনি একজন সহপ্রণেতা।

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, বাঘ ও হরিণের চোরা শিকার বন্ধ করতে হবে। বাড়াতে হবে শিকার প্রাণীর সংখ্যা। শিকার প্রাণী না থাকলে বাঘ থাকবে না। সাম্প্রতিককালে ডাকাত নির্মূল করা হয়েছে এটা ইতিবাচক। বাঘের খাবারে মানুষ যেন ভাগ না বসায়। তাহলে সুন্দরবনে দুই থেকে তিনগুণ বাঘ রাখা সম্ভব।

এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির কাজগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হয়। এটা সামগ্রিকভাবে চলমান রাখতে হবে। আমাদের এখানে প্রটেকশন এই লেভেলে এখনো পৌঁছায়নি। বাঘের আবাসস্থলে কেউ যেন আঘাত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুন্দরবন টিকিয়ে রাখতে হলে বাঘ টিকিয়ে রাখা জরুরি। বাঘই সুন্দরবনের বিশ্বস্ত পাহারাদার।’