মধ্যরাতেও লম্বা লাইন

মধ্যরাতেও লম্বা লাইন

রাত ১২টা। ফাঁকা সড়ক। মানুষের উপস্থিতি তেমন নেই। এই সময়ে রাজধানীর অধিকাংশ মানুষই ঘুমিয়ে পড়েন কিংবা ঘুমের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু গভীর রাতেও কিছু মানুষের চোখে ঘুম নেই । সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে নির্ঘুম থেকে টিসিবি’র লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। সরজমিন মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে এমন চিত্র দেখা যায় রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট এলাকায়। টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে প্রায় ১০০ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন কয়েকটি পণ্য নেয়ার জন্য।

টিসিবি’র লাইনে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। ট্রাক আসার কোনো নির্দিষ্ট সময়ও নেই। যখন খুশি তখনই পণ্য নিয়ে হাজির হয়। কোথায় ট্রাক আসবে তাও জানেন না অনেকে। তাই সড়কের মোড়ে মোড়ে থাকেন অপেক্ষায়। টিসিবি’র ট্রাক আসলেই তাড়াহুড়ো করে পেছনে ছুটে যায় অসহায় মানুষগুলো। লাইনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করে নিতে হয় পণ্য। এই ভোগান্তি এখন চিরচেনা চিত্র। তবে রাতের আঁধারে পণ্য নেয়ার চিত্র আরও করুণ।

টিসিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, টিসিবি’র ট্রাকের সংখ্যা বেড়েছে। রমজানের জন্য এখন পণ্যের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। তাই পণ্যগুলো ট্রাকে উঠাতে অনেক সময় লেগে যায়। সব ট্রাক সকালে ছাড়া যায় না। যখন যেই ট্রাকে পণ্য উঠানো হয় তখন সেটাকেই ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে ট্রাকে পণ্য ভরে ছাড়তে ছাড়তে দুপুর পার হয়ে যায়। এরমধ্যে সড়কের জ্যামের জন্যও গন্তব্যে পৌঁছাতে ট্রাকের সময় লেগে যায়।

এদিকে বৃহস্পতিবার রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন কদমতলা ওয়াসা রোডে দুপুরের পর টিসিবি’র ট্রাক আসে। এতে সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাকের চারপাশ ঘিরে ভিড় জমে যায়। শৃঙ্খলার জন্য প্রত্যেকের হাতে ক্রমিক নাম্বার লিখে দেন স্থানীয় কাউন্সিলরের প্রতিনিধি উজ্জল ইসলাম। তিনি বলেন, মানুষ যেন বিশৃঙ্খলা ছাড়া পর্যায়ক্রমে পণ্য নিতে পারে সেজন্য আমরা সিরিয়াল লিখে দেই। এতে সবার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন হয় না। অনেকে বাসা থেকে ঘুরেও আসেন। তার সিরিয়াল আসলে তাকে পণ্য দেয়া হয়।

দুপুরে টিসিবি থেকে পণ্য নিতে এসেছেন সেলিনা বেগম। তার সিরিয়াল ১১৪ নম্বর। এর আগে সকালে একবার এসে খোঁজ নিয়ে গেছেন। অল্পমূল্যে পণ্য পেলে তা দিয়ে ১৫ দিনের মতো চলে যায় তার। তিনি বলেন, আমাগো ৩০০-৪০০ টাকা দিয়ে খেজুর কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নাই। দুইটা টাকা বাঁচানোর জন্য লাইনে দাঁড়াইয়া জিনিসপত্র নেই। যে ক’টাকা বাঁচে তাই লাভ। এই টাকাই আমাগো কে দেয়।

সেলিনার স্বামী মো. জুয়েল। মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় হওয়াতে ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না। একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করে মাসে সাড়ে ৮ হাজার টাকা বেতন পান। এরমধ্যে পাঁচ হাজার টাকাই তার ঘরভাড়া দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব না। তাই সেলিনা মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এতে তার সামান্য কিছু আয় হয়। তবুও তার তিন সন্তান নিয়ে পাঁচ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

নন্দীপাড়া থেকে কদমতলা প্রায় দুই কিলোমিটারের পথ। সেখান থেকেই টিসিবি’র খোঁজ করে পণ্য নিতে এসেছিলেন রিনা খাতুন। তিনি বলেন, আমাদের ওদিকে টিসিবি’র গাড়ি দেখা যায় না। এখানকার একজন জানাইলো ট্রাকে মাল দিচ্ছে, তাই আইছি। কি করমু। জিনিসপত্রের দাম তো অনেক। এখান থেকে কম দামে কিছু মাল নেয়া যায়।

বৃদ্ধ ফজলুর করিম। এক সময় রঙয়ের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু বয়সের কারণে এখন আর করতে পারেন না। এক ছেলের উপার্জনেই খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন তারা। কম দামে পণ্য নিতে টিসিবি’র লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিও। তার হাতে ১২৭ নম্বর সিরিয়াল দেয়া হয়েছে। ফজলুর করিম বলেন, এর আগে কখনো নেই নাই বাবা। একবার আইছিলাম কিন্তু গাড়ি মাল দিয়া গেছেগা। তাই আজকে সিরিয়াল নিয়া লাইনে দাঁড়াইছি।-মানবজমিন