পুলিশের গোপন প্রতিবেদন

রমজানে বাজার আরো অস্থির হতে পারে

রমজানে বাজার আরো অস্থির হতে পারে

প্রতি বছরের মতো পবিত্র রমজানের দুই মাস আগেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিজেদের ইচ্ছেমতো নির্ধারণের ব্যাপারে ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেট’ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অতি মুনাফার আশায় এই অশুভ চক্র রোজায় বেশি ব্যবহৃত পেঁয়াজ, তেল, চিনির মতো পণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। তাদের সিন্ডিকেটের কারণেই মূলত বাজার বিভিন্ন সময় অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এই সিন্ডিকেটকে রোধ করার সুপারিশ করা হয়েছে পুলিশের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে। সম্প্রতি এ বিষয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহীল বাকী স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে প্রেরণ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধিতে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় ভোগান্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের উর্ধ্বমুখী এই প্রবণতা রমজান মাসের বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। গত প্রায় দুই বছর যাবৎ দেশের খুচরা বাজারে চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, আটাসহ বিভিন্ন রকম মসলার দাম কয়েক দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্যের সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে। দেশের বাজারে ঊর্ধ্বগতির এই প্রবণতা রোধ করা না গেলে রমজান মাসে বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

করোনায় দেশের উৎপাদন কিছুটা ব্যাঘাত, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর মুনাফালোভী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, মাছ- গোশত, ডিম এবং পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রোধ করা না গেলে রমজান মাসে বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের ৪২ শতাংশই হলো সয়াবিন তেল। গত সাত বছরের মূল্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের মূল্য প্রতি লিটার ৯০ টাকা থাকলেও বর্তমানে তা ১৭০ টাকা। অর্থাৎ গত সাত বছরে সয়াবিন তেলের মূল্য ৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন মাসে দেশের ছয়টি ব্যবসায়ী গ্রুপের ১০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৪ লাখ ছয় হাজার ৭৫২ মেট্রিকটন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়েছে। বাংলাদেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলে আমদানি ও বিপণনব্যবস্থা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই ছয়টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ছয়টি গ্রুপ হলো, টি.কে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, আদানী গ্রুপ উইলমার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। এই ছয়টি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানিকৃত অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি মূল্যের সাথে ৮ শতাংশ ভ্যালু যোগ করলে প্রতি লিটার তেলে বিক্রয় মূল্য সর্বোচ্চ ১৪৫ টাকা হওয়ার কথা। অথচ আমদানিকারকরা লিটারপ্রতি ১৭০ টাকা বিক্রি করে প্রতি লিটারে ২৫ টাকা মুনাফা করছে। এটি প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও তুরস্ক থেকে আমদানি হওয়ায় চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাব নেই।

দেশে বছরে চালের মোট চাহিদা তিন কোটি ৩৯ লাখ মেট্রিকটন। এর বিপরীতে দেশে বছরে প্রায় তিন কোটি ৭৪ মেট্রিকটন চাল উৎপাদিত হয়। এই মুহূর্তে দেশে চালের বাজারে কোনো ঘাটতি নেই। সরকারিভাবে সাত লাখ ২০ হাজার টন আমন ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ছয় লাখ ৩০ হাজার টন কেনা হয়েছে। দেশে চালের উৎপাদন আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। বিধায় রমজানে চালের সঙ্কট কিংবা সঙ্কটের কারণে মূল্য বৃদ্ধির তেমন কোনো আশঙ্কা নেই।

পেঁয়াজের পরিস্থিতি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিকটন এবং উৎপাদিত হয় প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিকটন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলেও যথাযথ সংরক্ষণ করতে না পারায় মোট উৎপাদনের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছরই ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ১২-১৪ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। বর্তমানে যথাযথ বাজার মনিটরিং নিশ্চিত করা গেলে আসন্ন রমজানে পেঁয়াজের বাজারে মূল্য স্বাভাবিক থাকবে।

সবজির বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেগুন, শসা, কাঁচামরিচ বারোমাসি সবজি হলেও শীতকালীন রবিশস্য হিসাবে এসব সবজির ফলন শীতকালেই বেশি হয়। এবার রমজান গ্রীষ্মের শুরুতে পড়ায় এসব সবজি বাজারে না ওঠা পর্যন্ত সরবরাহ তুলনামূলক কম থাকবে এবং রমজানে এসব সবজির মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের বাজারে গরম মসলার বাজার পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ঈদের আগে চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে গরম মসলার দাম আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, পণ্য আমদানির প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কিছু আমদানিকারক যুক্ত থাকায় আমদানি বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে পণ্যের আমদানি মূল্য নির্দিষ্ট কিছু আমদানিকারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা প্রয়োজনের নিরিখে পর্যাপ্ত না হওয়ায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর সুফল অধিকাংশ সময় ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায় না। অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে। অথচ আমদানিকৃত পণ্যের আমদানি আদেশের দুই মাস বা অনেক ক্ষেত্রে তার থেকেও বেশি সময় পরে দেশের বাজারে পণ্য সরবরাহ করা হয়। অন্যি দক, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। সারা দেশে টিসিবি ও ওএমএসের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজানেও অসাধু ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লাভের চেষ্টা করে।

এছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ১১টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলো হলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপের সিন্ডিকেট ব্যবস্থা রোধ করতে হবে। পণ্য আমদানিতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আরো অধিক সংখ্যক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে আমদানি প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা প্রয়োজন। সব ভোগ্যপণ্যের আমদানি, উৎপাদনস্থল থেকে পাইকারি এবং পরবর্তীতে খুচরা বিক্রেতা হয়ে ভোক্তার হাতে পৌঁছা পর্যন্ত প্রতি স্তরে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হ্রাস করার জন্য পণ্য হাত বদলে সংখ্যা কমিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সমুদ্র ও স্থলবন্দরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান। রমজানকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে অবৈধ মজুদ গড়ে তুলতে না পারে সে ব্যাপারে নজরদারি, আমদানিকৃত পণ্য সর্বোচ্চ কত শতাংশ মুনাফায় বিক্রয় করা যাবে তা আমদানি মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সময়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিসিবি ও ওএমএস কার্যক্রমকে মহানগর, জেলা, থানা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেগবান করা, শাক-সবজির মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন কৃষক ও উৎপাদক স্তরের মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ ও প্রকাশ, পণ্য পরিবহনে সব চাঁদাবাজি বন্ধ, দেশের সব বাজারে নিয়মিত মূল্যতালিকা হালনাগাদকরণ ও প্রদর্শন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গুজব সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধির অপচেষ্টা কঠোরভাবে দমন, কোনো কুচক্রী মহল সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার প্রয়াসে গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজার অস্থিতিশীল করার সুযোগ না পায় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার সুপারিশ করা হয়।